এহসান মাহমুদ:
গত মঙ্গলবার বিকেল। অফিসের এক সহকর্মীর সঙ্গে বসে কথা বলছিলাম। এক হাতে চায়ের মগ। আরেক হাতে মোবাইল। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে চোখ দিচ্ছি মোবাইলের স্ক্রিনে। ফেইসবুক স্ক্রল করতেই হঠাৎ একটি ছবিতে চোখ আটকালো জোনায়েদ সাকি রক্তাক্ত। তার নাক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। থুঁতনির পাশেও আঘাতের চিহ্ন। আশপাশে আরও কয়েকজন তাকে ধরে রেখেছেন। সবার মাথার ওপর দিয়ে দীর্ঘদেহী জোনায়েদ সাকিকে দেখা যাচ্ছে। তার সামনে কয়েকটি গণমাধ্যমের ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন। ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একজন আপলোড করেছেন। ক্যাপশন লিখেছেন ‘চট্টগ্রামে হামলার শিকার জোনায়েদ সাকি।’ বিস্তারিত জানার জন্য কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে ঢুঁ মারি। না, কোথাও এ বিষয়ক কোনো খবর দেখা যায় না। কিন্তু ফেইসবুকে আরও কয়েকজনের ওয়ালে একই ছবি দেখা গেল। আরেকটি ছবিতে দেখা গেল জোনায়েদ সাকির নাকের নিচে ও গালের একপাশে ব্যান্ডেজ। কাঁধ থেকে কনুই পর্যন্ত এক হাতেও মোটা ব্যান্ডেজ। অল্প সময়ের মধ্যেই ফেইসবুকের বেশ কয়েকজনের ওয়ালে এমন ছবি দেখা গেল। ফেইসবুকের ছবিতে প্রথমে বিশ্বাস আসে না। অতীতে অনেক সময়ে দেখা গেছে পুরনো ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। এমন ঘটনা সবচেয়ে বেশি হয় ঈদ যাত্রার ফেরিঘাটের ছবি ও ভিডিও নিয়ে। এছাড়া আগুনের ঘটনার ক্ষেত্রে এমন দেখা গেছে। পুরনো কোনো ঘটনার ছবি নতুন ঘটনার ছবি হিসেবে প্রচার করার মধ্য দিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল তাদের লক্ষ্যপূরণ করে।
তাই ফেইসবুকে জোনায়েদ সাকির রক্তাক্ত ছবি দেখে আরেকটু যাচাই করার ও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এই রক্তাক্ত হওয়া ছবি নতুন ঘটনা। ঘটনার স্থান চট্টগ্রাম। এরইমধ্যে এই ঘটনার বেশকিছু ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে এই বিষয়ক বিস্তারিত খবর প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিসহ তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ফটকে তাদের ওপর হামলা হয়েছে। জোনায়েদ সাকি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের হামলায় তিনিসহ অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। আহত অন্যরা হলেন গণসংহতি আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক হাসান মারুফ, সদস্য সচিব ফরহাদ জামান, ছাত্র ফেডারেশনের চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শ্রীধাম কুমার শীল, গণ-অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান, জসীম উদ্দিন এবং সদস্য কামরুন নাহার।
জোনায়েদ সাকিকে কারা হামলা করল, কেন হামলা করল এবার এই বিষয়ে তথ্য জানতে চেষ্টা করি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায় ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম শাখার নেতাকর্মীরা এই হামলা করেছে। তা ছাত্রলীগ হঠাৎ জোনায়েদ সাকিকে কেন হামলা করতে গেল? মনে পড়ল, সম্প্রতি বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে সাতটি দল ও সংগঠনকে নিয়ে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে গণসংহতি আন্দোলন। হামলার ঘটনার দিন দুপুরে ওই সাত দল ও সংগঠনের নেতারা সীতাকুন্ডে বিস্ফোরণস্থল বিএম কনটেইনার ডিপো দেখতে গিয়েছিলেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে জোনায়েদ সাকি বলেছেন, ডিপোতে এত বড় একটি দুর্ঘটনাকে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। দুর্ঘটনাটিকে নাশকতা বলে কোনো একটি পক্ষের ওপর দায় চাপানোরও চেষ্টা করা হচ্ছে। সীতাকুন্ড থেকে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান তারা। সেখানে সীতাকুন্ডের ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। দূর থেকে দেখেন আহতদের। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে মূল ফটকে রাখা গাড়িতে উঠতে গিয়েই ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন তারা। জোনায়েদ সাকি সাংবাদিকদের বলেছেন, গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে হামলা করা হয়েছে। তারা গাড়ি পুরোপুরি ভেঙে ফেলেছেন। কয়েক দফায় হামলাও করেছেন। জ্যেষ্ঠ নেতাদেরও ছাড় দেননি। বেধড়ক মারধর ও হামলায় তার নাক ফেটে গেছে, হাত কেটে গেছে। এই হামলার বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি ইমরান আহমেদের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ায় সাধারণ ছাত্র ও প্রতিবাদী যুবকরা জোনায়েদ সাকিদের প্রতিহত করেছেন’।
এবার ‘সাধারণ ছাত্র ও যুবকদের প্রতিহত করার’ আরেকটি ঘটনা বলি। এটাও সাম্প্রতিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে ছাত্রলীগ। এ হামলায় ছাত্রদলের অন্তত ৩০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে। একই সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। একইদিন সিলেট শহরের আলিয়া মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ছাত্রদলের ওপর হামলাকে ‘প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ’ বলে দাবি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘ছাত্রদল তাদের সহিংস সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ বিঘ্নিত করছে। এর ধারাবাহিকতায় তারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে। শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপদ শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করার স্বার্থে সব মতের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছাত্রদলের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।’ (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো)।
ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এই শীর্ষ নেতার বক্তব্য আমাকে আশাবাদী করে তুলেছে। ‘সাধারণ শিক্ষার্থী ও প্রতিবাদী যুবকরা’ একত্রিত হয়ে অন্য একটি ছাত্র সংগঠনকে ‘কটূক্তি’ করার অভিযোগে হামলা করতে পারে, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সজ্জিত হয়ে ক্যাম্পাস ‘পাহারা’ দিতে পারে বেশ আশাজাগানিয়া খবর।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘বীজমন্ত্র’ যাকে বলা হয় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, তার নেতৃত্বে ছিলেন সে সময়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের প্রতিবাদের মুখেই নতুন ইতিহাস তৈরি হয়েছিল। এরপরে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থ্যান, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে হালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল সম্মুখ সারিতে।
এখন বিরোধী দলের ও মতের ছাত্রসংগঠনের ওপর হামলা ‘জায়েজ’ করতে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন ও ছাত্র সংগঠনসমূহ যেভাবে নিজেদের ‘সাধারণ শিক্ষার্থী ও প্রতিবাদী যুবক’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের যে চেতনা ও আদর্শ তার পরিপন্থী।
প্রশ্ন জাগে, দেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে আবাসন সংকটের বাস্তবতার মধ্যে যখন গণরুম-ব্যবস্থা টিকে থাকে আর যখন হলে উঠতে গেলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠনের দ্বারস্থ হতে হয় তখন ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’র অধিকার কে বা কারা দেখে? এরপর যখন হলের গণরুমে ওঠা নবীন শিক্ষার্থীদের ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হয় তখনই বা তাদের রক্ষাকবচ কী থাকে?
এই বাস্তবতায় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বাইরে গিয়ে যদি সাধারণ শিক্ষার্থীরা সত্যিই নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যটুকু বুঝতে পারেন তাহলে তা ছাত্ররাজনীতির নতুন পথের সন্ধান দিতে পারবে বলেই বিশ্বাস করি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.