চিররঞ্জন সরকার:
পৃথিবীতে অনেক বড় বড় সেতু নির্মিত হয়েছে। চীনের জিয়াংসু প্রদেশে ১৬৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু বানানোর নজির আছে। ৮.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত ‘ড্যানইয়াং কুনসান গ্র্যান্ড ব্রিজ’ নামক এই সেতুটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সে তুলনায় আমাদের পদ্মা সেতু খুবই ছোট্ট একটা সেতু, এর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। দৈর্ঘ্যরে দিক বিবেচনায় পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে বিশ্বের ১২২তম দীর্ঘ সেতু। কিন্তু এই সেতুটিই আমাদের কাছে হাজার বছরের সবচেয়ে বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন আর প্রত্যাশা যেন পদ্মা সেতুকে করেছে আরও মজবুত। বাংলাদেশ, চীন ও ইউরোপের প্রায় ১২০০ প্রকৌশলী এবং ২০ হাজার শ্রমিকের শ্রম, ঘাম ও মেধা দিয়ে নির্মিত হয়েছে এ সেতু। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর শুরুর পর এক দিনের জন্যও বন্ধ থাকেনি কাজ। কর্মযজ্ঞ চলমান ছিল ঈদসহ সব ছুটির দিনেও। নানা চড়াই-উতরাই, অনেক সন্দেহ-সংশয়, লাগাতার সমালোচনা পেরিয়ে তৈরি হয়েছে এই সেতু। এই সেতু বাংলাদেশের জন্য ‘নেশন বিল্ডিং প্রজেক্ট’। দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত করবে এই সেতু। বদলে দেবে অর্থনীতির চেহারা।
কিন্তু এই সেতু নির্মাণের কাহিনী এত সোজাসাপ্টা নয়। নানা প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। নিজস্ব অর্থে এ সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশ আজ তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। জাতির এ গৌরবের অংশীদার দেশের ১৭ কোটি মানুষ। কিন্তু আমাদের সমাজের কিছু লোক আছে, দল আছে যাদের ভালো কাজে গাত্রদাহ হয়। দেশের উন্নয়ন, মর্যাদায় তারা যেন খুশি হতে পারে না। আর শেখ হাসিনা যদি এসব ভালো কাজের কাণ্ডারি হন তবে তো কথাই নেই। ছিদ্রান্বেষণ করে এর ত্রুটি বের করতেই হবে। সেটিও যদি পাওয়া না যায়, তবে মনগড়া মিথ্যাচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার শেষ অস্ত্রও ব্যবহার করতেই হবে। সব প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু যখন নির্মিত হয়েই গেল; তখন এরা বলতে শুরু করল পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ অনেক বেশি হয়েছে দুর্নীতি হয়েছে। সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা করা বিরোধী দলের দায়িত্ব এবং সেটা করাই উচিত। কিন্তু মুশকিল হলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকাকালে একরকম আর বিরোধী দলে থাকাকালে আরেকরকম আচরণ করে। বিরোধী দলে থাকলে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে মিথ্যাচার ও কুৎসার আশ্রয় নিয়ে থাকে।
প্রকল্পযাত্রা থেকে বাস্তবায়ন, পুরো সময়টাই পদ্মা সেতু নিয়ে একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন বিএনপি নেতারা। কখনো বিরোধিতা, কখনো দুর্নীতির অভিযোগ, কখনো বা সেতুর পেছনে নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করা হয়েছে। নানা সময়ে এমন নানা অবস্থান নিয়ে সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দলটি। এমনকি বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ানোর পর কেউ কেউ দাবি করেন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগও। আর বিএনপি চেয়ারপারসন তো প্রকাশ্য সমাবেশেই নেতাকর্মীদের বারণ করেন সেতুতে উঠতে। ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এক সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য ছিল এমন, ‘পদ্মা সেতু কি হচ্ছে? হচ্ছে না। এ সরকার পদ্মা সেতুও করতে পারল না।’ এর পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি আবারও একই ধরনের মন্তব্য বিএনপি চেয়ারপারসনের। আবারও কটাক্ষ করে বলেন, ‘পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে আর হবে না। আর যদি সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানায়, সেই সেতুতে কেউ উঠতে যাবেন না। অনেক রিস্ক আছে।’ পিছিয়ে ছিলেন না দলের অন্য নেতারাও। সুর মেলাতে থাকেন খালেদা জিয়ার বক্তব্যের সমর্থনে। বিএনপি মহাসচিব দাবি করেন, ‘টিকবে না পদ্মা সেতু।’ ১১ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘একটা ভ্রান্ত ও ভুল ডিজাইনের ওপরে পদ্মা সেতু নির্মিত হলে সেটা যে টিকবে না, সেটা তো উনি (খালেদা জিয়া) ভুল বলেননি। এটা সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, পদ্মা সেতু রং (ভুল) ডিজাইনের ওপরে নির্মিত হচ্ছে।’ অবশ্য প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ানোর পর থেকেই বেশ আক্রমণাত্মক বিএনপি নেতাদের বক্তব্য। ঋণ বাতিলের ঘোষণার দিনই বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলেও পদ্মা সেতু আর হবে না আওয়ামী লীগ আমলে। দুর্নীতির কাঠগড়ায় দাঁড় করান প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারকে।’
২০১২ সালের ১ জুলাই খালেদা জিয়া বলেন, ‘পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা জড়িত। সেতুর কাজ শুরু হওয়ার আগেই সরকার বিরাট দুর্নীতি করেছে। তাই এ সরকারের আমলে আর পদ্মা সেতু হবে না।’ আর দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার। সমালোচনা করা হয়, বিকল্প অর্থায়ন অনুসন্ধানের। বলা হয়, ‘দুর্নীতির দায় নিয়ে সরকারের এখনই সরে যাওয়া উচিত। এ সরকার এখন আন্তর্জাতিকভাবে দুর্নীতিতে স্বীকৃত।’ সেতু নির্মাণ নয়, বরং ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতিই সরকারের লক্ষ্য এমন ছিল ব্যারিস্টার মওদুদের কণ্ঠে। ২০১২ সালের ১৫ জুন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অভিযোগ ছিল, নিজস্ব অর্থায়নে সেতুর নামে নির্বাচনী তহবিল করতে চায় সরকার। সেতু নির্মাণের নামে টাকা সংগ্রহের নতুন ধান্ধা শুরু করেছে। আর পদ্মা প্রকল্প ডেকে আনবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মৃত্যু এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ। এমনকি কানাডার আদালতে দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরও বিএনপি নেতাদের সাফাই ছিল বিশ্বব্যাংকের সমর্থনে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের সমালোচনাকারী বিএনপি নেতাদের অনেকেই আজ পরলোকে। জীবিত যারা আছেন, তারাও নানা মন্তব্য করে চলেছেন। পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নেওয়ার পরও থেমে নেই কটাক্ষ। চলতি বছরের ২৭ মে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম বলেন, ‘আজকের এই পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে আমাদের চেক করে দেখতে হবে আবার বাঁশ দিয়েছেন কি না।’ অন্যদিকে, আবার নিজেদের কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টাও করেছেন বিএনপি মহাসচিব। ৫ জুন তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় পদ্মার দুই পাড়েই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন খালেদা জিয়া।’ বিএনপির দেউলিয়া রাজনীতিকে আরও দেউলিয়া করে বর্তমান সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে। সব মিথ্যাচার, কুৎসা আর ষড়যন্ত্রের জবাব এই পদ্মা সেতু। আসলে পদ্মা সেতু কেবল ইট-পাথর-লোহা-সিমেন্টের তৈরি সেতু নয়। এর সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, আবেগ। আছে এই সেতু যেন না হতে পারে এর জন্য জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র, অপতৎপরতা। অবশ্য সরকারবিরোধী, আওয়ামী-বিদ্বেষী শ্রেণি ছাড়া দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কাছে এই সেতু হচ্ছে একই সঙ্গে ভালোবাসা ও গৌরবের। পদ্মা সেতু আমাদের উন্নয়নের প্রতীক, সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতীক, হার না-মানার প্রতীক!
লেখক লেখক ও কলামিস্ট/chiros234@gmail.com
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.