মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মহামারী কভিড-১৯ এর কারণে বিগত দুই বছর সীমিত মানুষ পবিত্র হজপালনের সুযোগ পেয়েছেন। চলতি বছর দেশ-বিদেশের ১০ লাখ হজযাত্রী হজপালন করবেন। মহামারীর আগে ২৪ লাখের বেশি লোক হজপালন করতেন। এবার দেশ-বিদেশের ১০ লাখ নাগরিক হজপালন করবেন। তারমধ্যে বাংলাদেশের হজযাত্রী ৬০ হাজার। ইতিমধ্যে পবিত্র হজ উপলক্ষে সৌদি আরবের মক্কা-মদিনায় সমবেত হয়েছেন লাখ লাখ মুসলমান। যারা হজপালনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। দয়াময় আল্লাহ তাদের আশা পূরণ করায় এসব হাজি এখন আল্পুত ও অভিভূত।
প্রত্যেক মুসলমানই হজপালনের আকাক্সক্ষা হৃদয়ে লালন করেন। মুসলমানরা যে কাবাঘরের দিকে মুখ করে প্রতিদিন নামাজ আদায় করেন, সেই ঘরকে সরাসরি সামনে রেখে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ এবং নামাজ আদায়ের অনুভূতিই ভিন্ন- এটা বলে বা লিখে বুঝানো কঠিন। হজযাত্রার মধ্যদিয়ে একজন মুসলমানের আজন্ম লালিত ইচ্ছা বাস্তব রূপ লাভ করে। তবে আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম নারী-পুরুষের ওপরই কেবল হজ ফরজ। হজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা আলে ইমরানের ৯৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেসব মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে।’ ইসলামি পরিভাষায় হজ হলো, নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে বিশেষ কিছু কাজ সম্পাদন করা।
হজপালনে গিয়ে মুমিন-মুসলমানের মুখের ভাষা হয়- ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাজির। এভাবে একজন হাজি কাবা শরিফ তাওয়াফ, সাফা-মারওয়া সাঈ এবং মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতের ময়দানে অবস্থানসহ অনান্য কার্যাদির মাধ্যমে হজপালন করেন। সব মিলিয়ে হজ দুই অক্ষরের একটি ছোট শব্দ হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্ব মুসলিমের পরম আবেগ-অনুভূতি ও ধর্মীয় বিশ্বাস। নাস্তিকতা ও অংশীবাদকে প্রত্যাখ্যান করে একত্ববাদের ঝান্ডা উড্ডীন রেখে আল্লাহর আরও নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে মুসলমানরা হজে যান। সেখানে তারা গোটা মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে সব মুসলমানের সম্মান-মর্যাদার কথা ভাবেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। মুসলমানরা কেবল হজের নানা কার্যক্রমের বাহ্যিক দিকগুলো নিয়েই ভাবেন না, তারা এসবের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়েও চিন্তা করেন এবং সবক্ষেত্রেই এর প্রভাব প্রত্যাশা করেন।
হজ একটি আদর্শ মুসলিম সমাজের প্রতীক। সব ধরনের বাহ্যিক ভেদাভেদ ভুলে মুসলমানরা এখানে সমবেত হন। এ সময় তারা পরস্পরের সুখ-দুঃখ, দুর্বলতা এবং সম্ভাবনার নানা দিক সম্পর্কে অবহিত হন। ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, আল্লাহর দেওয়া প্রতিটি বিধানের মধ্যে রয়েছে ইহকালীন ও পারলৌকিক কল্যাণ। এরই ধারাবাহিকতায় হজের বিধান দেওয়া হয়েছে যাতে পূর্ব ও পশ্চিমের মানুষ আল্লাহর ঘরকে ঘিরে সমবেত হন এবং পরস্পরকে চিনতে পারেন। এছাড়া আল্লাহ চান মুসলমানরা নবী কারিম (সা.)-এর নানা নিদর্শন ও বিষয় সম্পর্কে জানুক এবং এসব বিষয় মনে রাখুক।
সামগ্রিকভাবে হজ হলো, মানবীয় উন্নয়ন ও পূর্ণতায় পৌঁছার লক্ষ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের একটি সমৃদ্ধ অঙ্গন। এই অঙ্গন থেকে নিজেকে বিচিত্র ঐশী অলংকার দিয়ে সুসজ্জিত করে সেগুলোকে আপন দেশ এবং জাতির জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে হজযাত্রীদের জন্য।
বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর জন্য অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রয়োজন, এমন কিছু মানুষ- যারা একনিষ্ঠ ইমান ও আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেদের চিন্তা ও কাজকে পরিচালিত করে, যারা আত্মিক ও আধ্যাত্মিকতা চর্চার মাধ্যমে আত্মগঠনের পাশাপাশি শত্রুদের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এটাই বৃহৎ মুসলিম সমাজে দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান বিচিত্র সমস্যা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। চাই সেসব সমস্যা ইমানের দুর্বলতা থেকে হয়ে থাকুক কিংবা শত্রুদের নিপীড়ন থেকে। নিঃসন্দেহে বর্তমান যুগ মুসলমানদের পরিচয়, মুসলমানদের স্বরূপ খুঁজে পাওয়ার এবং ইসলামি জাগরণের যুগ। বিচিত্র চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন মুসলিম দেশগুলোকে অবশ্যই এই কঠিন সত্য উপলব্ধি করতে হবে। তবে এটাও সত্য, বর্তমান পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর ভরসা করে দৃঢ় ইমানের ভিত্তিতে স্থির সংকল্প ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে মুসলিম দেশ ও জাতিগুলো এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিজয় লাভ করতে পারে। এভাবে মুসলমান জাতি তাদের সম্মান ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে পারে। এমতাবস্থায় পবিত্র হজের দুই শিক্ষা হতে পারে আলোকবর্তিকা। এক. একত্ববাদের ছায়ায় মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। দুই. শত্রুকে চেনা এবং তার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা।
মুসলিম জাতি ও সংস্কৃতি গঠনে হজরত ইবরাহিম (আ.), হজরত ইসমাঈল (আ.) ও হজরত হাজেরা (আ.)-এর অবদান অনস্বীকার্য। তাদের সংগ্রাম, কর্মতৎপরতা, অপরিসীম ত্যাগ ও কোরবানি গোটা মুসলিম জাতির জন্য আদর্শ। হজের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে ইবরাহিমি ঐতিহ্যের স্মারক বিদ্যমান। এখানেও রয়েছে প্রভূত শিক্ষার বিষয়। মুসলিম জাতির আদি পিতা হজরত ইবরাহিমের সঙ্গে উম্মতে মোহাম্মাদির সংযোগ স্থাপনের প্রতীকী মহড়া হজের অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে সুদূর অতীত আর বর্তমান একাত্ম হয়ে ওঠে। একইভাবে হজের সঙ্গে রয়েছে কোরবানির নিয়ম। এই কোরবানি নিছক পশু কোরবানি নয়, এ হচ্ছে সত্যের জন্য, আল্লাহর জন্য, তার ধর্মের জন্য সবকিছু বিলিয়ে দেওয়ার মহড়া। এর মাধ্যমে পরীক্ষা হয় বান্দা আল্লাহকে কতটা ভালোবাসে, কতটা ভয় করে।
যাদের আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য রয়েছে, কেবল তাদের জন্যই হজ ফরজ। সাধারণত যারা আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান তাদেরই নানা দিক থেকে বিচ্যুতির আশঙ্কা থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, ধনীরা যদি পরিশুদ্ধ মনের অধিকারী না হন তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রে অন্যায় ও অপকর্মের ক্ষেত্র তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। মনে রাখতে হবে, অর্থ-সম্পদসহ মানুষের সবকিছুই আল্লাহর দান। তা আর্থিক, জ্ঞানগত, মানসিক কিংবা শারীরিক যাই হোক না কেন। আল্লাহ মানুষকে যা দিয়েছেন তার প্রত্যেকটির হিসাব দিতে হবে। এ কারণে হজ আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান মানুষের জন্য পরিশুদ্ধ হওয়ার একটি সুযোগ। পবিত্র হজপালনের পর হাজিরা যেমন পরিশুদ্ধ হন, তেমনি আপন পরিবার, সমাজ ও দেশে ফিরে অন্যদের পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। পরিশুদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকুক কিয়ামত পর্যন্ত।
লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.