মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
দশ জিলহজ ইয়াওমুন নাহর তথা কোরবানির দিন। বাংলাদেশের মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে রবিবার নিজ নিজ পশু কোরবানি দেবেন। এ দিনকে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত দিন বলেছেন। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘দিনগুলোর মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো, নাহরের (কোরবানির) দিন। এরপর এর পরবর্তী দিন (কোরবানির দ্বিতীয় দিন)।’ -সুনানে আবু দাউদ : ১৭৬৫
দিনটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘আমাকে এ দিবসে কোরবানির আদেশ করা হয়েছে, এ দিবসকে মহান আল্লাহ এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন।’ -মুসনাদে আহমাদ : ৬৫৭৫
কোরবানি ওয়াজিব আমল। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। কোরবানি মুসলমানের ভেতরে-বাইরে পরিবর্তনের স্পন্দন জাগায়। এ উপলক্ষে মুসলিম নারী-পুরুষের মনে জাগে পুণ্যের প্রেরণা। চলে ঘরে ঘরে কোরবানির প্রস্তুতি। মসজিদে মসজিদে বয়ান ও আলোচনা। সব কিছু মিলে ব্যক্তি ও সমাজে ইবাদত-বন্দেগির এক পুণ্যময় স্পন্দন জেগে ওঠে। এটি খুবই ইতিবাচক একটি বিষয়। এজন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা কর্তব্য। শত নাফরমানি সত্ত্বেও তিনি আমাদের তার ইবাদত-বন্দেগির সঙ্গে, তার আনুগত্যের কিছু বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছেন- এটি আল্লাহর বিশেষ কৃপা ও করুণা।
শুক্রবারের জুমা, রমজানের ঈদ, জিলহজ মাসের হজ-কোরবানিসহ ইবাদত-বন্দেগির বিভিন্ন মৌসুমে জাগ্রত হওয়া ইমানকে কার্যকর রাখা নৈতিক দায়িত্ব। কাজেই আমাদের কর্তব্য, এই নিয়ামতের সম্মান করা। প্রশ্ন হলো, এই নিয়ামতের কদর কীভাবে হবে? ইসলামি স্কলারদের অভিমত, এই নিয়ামতের কদর হবে এই ইমানি কণিকাকে ইমানি প্রদীপে পরিণত করার দ্বারা, যার জ্যোতির্ময়তায় মুসলমানদের চেতনা ও বিশ্বাস, কর্ম ও আচরণ জ্যোতির্ময় হয়ে উঠবে।
কোরবানিতে আমাদের জন্য রয়েছে গভীর বার্তা। এটা আল্লাহর ইবাদত, তাওহিদ ও সুন্নাহ এর প্রাণ। কোরবানির সময় মুমিনের মনে ও মুখে থাকে তাওহিদের বাণী। আর কোরবানিসহ সব ইবাদত তখনই ইবাদত হয়, যখন তা আদায় করা হয় সুন্নত মোতাবেক। মুসলমানরা ওই নিয়মেই কোরবানি করেন, যে নিয়ম নবী কারিম (সা.) দেখিয়ে গেছেন। এটাই সুন্নতের অনুসরণ। এভাবেই তাওহিদ ও সুন্নাহর শিক্ষা আমাদের গোটা জীবনে পরিব্যাপ্ত।
সুতরাং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো মুসলমান কোরবানি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন না। নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপরই কেবল আল্লাহ কোরবানি ওয়াজিব করেছেন। যার সামর্থ্য নেই তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। আর অর্থ-সামর্থ্য তো মহান আল্লাহ দান করেন। আল্লাহর দেওয়া সম্পদ থেকেই তো আমরা কোরবানি করি। এটি তার দানের শুকরিয়া। সামর্থ্য থাকার পরও যদি কোনো মুসলিম কোরবানি না করেন, সেটা হবে আল্লাহর দানের নাশোকরি, এর পরিণাম ভয়াবহ। এ জন্যই কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন দয়াল নবী। ইরশাদ হয়েছে, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩১২৩
সামর্থ্যবানদের মধ্যে যারা কোরবানি করবেন, তাদের উদ্দেশ্য হতে হবে- একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করা। লোক দেখানো, মানুষের বাহবা কুড়ানো যেন কোরবানির লক্ষ্য না হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের (কোরবানির পশুর) গোশত আর না তাদের রক্ত, বরং তার কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে।’ -সুরা হজ : ৩৭
কোরবানিতে যেহেতু নির্দিষ্ট পশু জবাই করতে হয়, তাই অহেতুক কষ্ট দেওয়া ছাড়া সুন্দরভাবে পশু জবাইয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। এটাই ইসলামের নির্দেশ। হজরত শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা সব কিছুর ওপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা (জবাই) করবে, তো উত্তম পদ্ধতিতে করো। যখন জবাই করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে জবেহ করো। প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দেবে এবং তার পশুকে শান্তি দেবে।’ -সহিহ মুসলিম : ১৯৫৫
কোরবানির পশুর গোশত শুধু নিজে নয়, অন্যদেরও খাওয়ানো দরকার। ইরশাদ হয়েছে, ‘কোরবানির উট (ও গরু)-কে তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলির অন্তর্ভুক্ত করেছি। তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং যখন তা সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়ানো থাকে, তোমরা তার ওপর আল্লাহর নাম নাও। তারপর যখন (জবেহ করার পর) তা কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, তখন তার গোশত থেকে নিজেরা খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে খাওয়াও এবং তাকেও যে নিজ অভাব প্রকাশ করে না। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। -সুরা হজ : ৩৬
সমাজে এমন অনেক অভাবী আছেন, যারা কোরবানিকেই শুধু গোশত খাওয়ার উপলক্ষ হিসেবে বিবেচনা করেন। তারা আশায় থাকেন, কোরবানি উপলক্ষে গোশত খাওয়ার। এমন অভাবী ও অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে আপনার পশুর কোরবানি। শুধু আত্মীয়-স্বজন ও অভাবী মুসলিম নয়, কোরবানির গোশত অমুসলিমদেরও দেওয়া যায়। এতে অসুবিধার কিছু নেই। বিশেষত অমুসলিম যদি প্রতিবেশী হয়। কারণ, প্রতিবেশী হিসেবে তার হক রয়েছে। সাহাবিরা অমুসলিম প্রতিবেশীর হকের প্রতি সবিশেষ লক্ষ রাখতেন।
করোনা পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারণে মানুষের মধ্যে বিগত বছরের তুলনায় কোরবানি নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সত্যানুসন্ধানী মুমিন-মুসলমানদের কর্তব্য হলো, কোরবানির মাসয়ালা জেনে পদক্ষেপ নেওয়া। কোনো ধরনের অনুমান কিংবা বিভ্রান্তিকর প্রচারের ফাঁদে পড়ে ওয়াজিব আমল থেকে বিরত না থাকা। হাদিসে আছে, ‘কোরবানির দিন আদম সন্তানের আর কোনো আমল নেই যা আল্লাহর কাছে রক্ত প্রবাহিত (পশু কোরবানি) করার চেয়ে প্রিয়। এই কোরবানি কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে তার শিং, খুর ও চুল সহকারে। আর কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা পৌঁছে যায় আল্লাহর সন্তুষ্টির স্থানে। সুতরাং এতে তোমাদের চিত্ত প্রফুল্ল হোক।’ -জামে তিরমিজি : ১৪৯৩
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.