চিররঞ্জন সরকার:
ফিলিপাইনে মার্কোস, রোমানিয়ায় চসেস্কু, বাংলাদেশে এরশাদের পরিণতি আমরা দেখেছি। এবার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাতেও আমরা গোতাবায়া রাজাপাকসের পরিণতি দেখলাম। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি ভবনের ছবিটা ভাইরাল হয়েছে। বাগানে অসংখ্য বিক্ষুব্ধ মানুষ, পালঙ্কের ওপর চলছে কুস্তি কুস্তি খেলা, জিমে ট্রেডমিল করার জন্য ঠেলাঠেলি চলছে, আবার সোফায় এক সিংহলী শুয়ে কখনো কুশনটা মাথার নিচে দিচ্ছে, কখনো চাপাচ্ছে বুকের ওপর। রাষ্ট্রপতি ভবনে মচ্ছব করার সুযোগ মিলবে, সেটা তারা ভাবেইনি। ফলে অপ্রত্যাশিত ‘লাক বাই চান্সে’ তারা দিশেহারা।
গোতাবায়া রাজাপাকসের বাসভবনে শ্রীলঙ্কার বিক্ষুব্ধ মানুষের অবাধ বিচরণ, বিশ্রাম ও বিনোদনের দৃশ্যগুলো বিখ্যাত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর দি অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক কাহিনীর প্রথম দৃশ্যটি মনে করিয়ে দেয় অতিকায় সিংহ দরজায় ‘কেবল একটি ঠেলা দেওয়ার দরকার ছিল’। দক্ষিণ আমেরিকার সেই নামহীন স্বৈরতন্ত্রের পরিণতির সঙ্গে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির ফারাক বিস্তর, কিন্তু শাসক এবং শাসিতের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধানের ছবি দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে প্রকট হয়ে উঠল, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য দেশ বা কালের গণ্ডিতে সীমিত নয়। বিশ্বের ইতিহাসে এবং গল্পে উপন্যাসে শিল্পকৃতিতে নাটকে সিনেমায় অনেক বার দেখা গণজাগরণের এই দৃশ্য জানিয়ে দিল, জনসমর্থন পেলেই হয় না, তাকে ধরে রাখতে হয়। তা না হলে, অতি বড় শক্তিমান শাসকের গদিও টলমল করতে পারে।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে মহাশক্তিমান হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন। সেই খ্যাতির পেছনে ছিল দেশের উত্তরাঞ্চলে তামিল প্রতিরোধ ধ্বংস করতে তার দাদা, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের সেনাপতির ভূমিকায় গোতাবায়ার নির্মম অভিযান, যে অভিযান তার ভয়াবহ অমানবিকতার কারণে দুনিয়াজুড়ে নিন্দিত হয়, কিন্তু সংখ্যাগুরু সিংহলী বৌদ্ধ সমাজের বিপুল সমর্থন পায়। ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার জয়ের পেছনে এই ইতিহাসের বড় অবদান ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয় সেই বছরের এপ্রিলে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা দেশের মানুষ সন্ত্রাস দমনের জন্য শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট চেয়েছিলেন। পরিবারতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে তিনি শক্তিশালী হয়েও উঠেছিলেন। তিন বছরের মধ্যে অজস্র জনকণ্ঠে ‘ভাগো গোতা, ভাগো’ ধ্বনির তাড়নায় তাকে যে উল্টোরথে চড়ে পালাতে হয়েছে, তার কারণ, চূড়ান্ত আর্থিক বিপর্যয়, বুকের ছাতি, বাহুর পেশি বা বোমারু বিমান দিয়ে যে বিপর্যয় রোধ করা যায় না।
বিপর্যয়ের কিছুটা শিবকীর্তি বটে, কিন্তু নিজকীর্তিই প্রধান। সন্ত্রাসী হানা এবং অতিমারীর উপর্যুপরি প্রকোপ পর্যটন শিল্পে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছে, যে শিল্পটি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলেও খাদ্য এবং জ্বালানির জোগানে টান পড়েছে, দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক গতিতে। কিন্তু বহিরাগত বিপদের মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় বিচক্ষণতা ও সৎসাহসের পরিচয় দেখাননি মহাশক্তিমান গোতাবায়া, উল্টে নির্বুদ্ধিতা ও গোঁয়ার্তুমির মারাত্মক মিশেল দিয়ে একের পর এক আত্মঘাতী গোল দিয়েছেন। খাদ্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো যখন অত্যন্ত জরুরি ছিল, তখন রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। খাদ্যের ফলন বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে। অতিমারী-বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখে রাজকোষের ঘাটতি সামলানোর চেষ্টা না করে ‘বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে’ করের হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার ফলে সরকার এখন সম্পূর্ণ দেউলিয়া।
এর সূচনা হয়েছিল কিন্তু বছর সাতেক আগেই। চাপতে শুরু করেছিল ধারের বোঝা। ২০১৫ সালে রনিল বিক্রমাসিংহে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তখনই তিনি একটি অর্থনৈতিক পলিসি এনে গোটা বিষয়টি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শরিক সরকারের বায়নাক্কায় তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তারপর একে একে এসেছে নানা বিপর্যয়। করোনা মহামারীর ধকল সামলে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সর্বনাশের চূড়ান্ত বাঁশি বাজিয়েছে।
১৯৯৭ সালে বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ডে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়া শ্রীলঙ্কার দেনার পরিমাণ প্রায় ৮৬০ কোটি মার্কিন ডলার। মানুষের ক্ষোভ তাই আজ বিদ্রোহের আকার নিয়েছে। পালিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। বিরোধীরা সরকার গড়ার তোড়জোড় শুরু করেছে। কিন্তু এতেও কি সমস্যার সমাধান হবে? দেশের নাম যাই হোক না কেন, সবার আগে মানুষ চায় শুধু খেয়েপরে বাঁচতে। সাধারণ পরিষেবাগুলো যেন পাওয়া যায়, এটাই প্রাথমিক চাহিদা। সেই চাহিদাগুলো পূরণ করার সামর্থ্য শ্রীলঙ্কা হারিয়ে ফেলেছে।
আমাদের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো না হলেও ‘পায়ের ওপর ঠ্যাং তুলে’ নিশ্চিন্তে কাটানোর মতো নয়। আমাদের আমদানি ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সে তুলনায় রপ্তানি কম। রিজার্ভের পরিমাণও কমছে। করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দ্বীপরাষ্ট্রের মতো আমরাও কিন্তু ধুঁকছি! কারণ, দুই দেশের অর্থনীতির দুর্বল দিক একই স্বল্প কর, রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা এবং স্বল্প পরিমাণে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ। তবে, বাংলাদেশের হাতে এখনো শ্রীলঙ্কার মতো বিপর্যয়ে না পড়ার মতো যথেষ্ট সময় আছে।
বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশ। ফলে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার মতো বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নেওয়ার সুযোগ আছে। ২৫ থেকে ৪০ বছরের দীর্ঘ মেয়াদের এসব ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত আরও সময় পাওয়া যায়। পাশাপাশি, এসব ঋণের সুদের হার দুই শতাংশেরও কম।
তারপরও আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। চারদিকের আলামত কিন্তু স্বস্তির নয়। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। বেড়েছে সিলিন্ডার গ্যাসের দাম। মূল্যবৃদ্ধির আঁচে প্রতিদিন দগ্ধ হচ্ছে দেশবাসী। চাল, ডাল, আটা, ভোজ্য তেল সর্বত্র ছেঁকা লাগার জোগাড়। কভিড ও লকডাউনের কারণে চাকরি-বাকরিতে এবং রোজগারে যে কোপ পড়েছিল, তার ঘা আজও শুকায়নি। চাকরির বাজার প্রশস্ত হচ্ছে না। ঋণের বোঝা বাড়ছে। মধ্যবিত্ত হয়েছে নিম্নবিত্ত, আর নিম্নবিত্ত গরিব। ফায়দা লুটছে শুধু উচ্চবিত্ত শ্রেণি। কয়েকটি করপোরেটের হাতে এখন দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থ।
এই পরিস্থিতিতেও মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম টেনে ধরার কোনো উপায় সরকারের জানা আছে বলে মনে হচ্ছে না। তার দিশাও দেখা যাচ্ছে না। কৃষিতে ঘাটতি, নতুন শিল্প নেই, সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি শুধু খাতায় কলমে, এরপরও কি অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করা যায়? না যায় না। বরং আশঙ্কার সিঁদুরে মেঘ এখন ঘোরাফেরা করছে আকাশে।
ন্যূনতম চাহিদা পূরণ না হওয়ায় শ্রীলঙ্কার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। লেখা স্লোগান, দাবি : ‘গিভ আওয়ার স্টোলেন মানি ব্যাক’। আমাদের ধাপ্পা দিয়ে যে টাকা চুরি করেছ, তা ফেরত দাও। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। শ্রীলঙ্কার মানুষ এখন চাইছে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎটা সুরক্ষিত করতে। তাই এই বিক্ষোভ, আন্দোলন। সুখী গন্তব্যের দিশা হয়তো এটাই!
সতর্ক হওয়ার সময় কিন্তু আমাদেরও এসেছে। ক্ষোভ দানা বাঁধছে সাধারণ মানুষের মনে। একজন, দুজন, তিনজন, সংখ্যাটা এখন হয়তো হাতেগোনা। কিন্তু কাল এই সংখ্যাটাই অগুনতি হতে পারে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটলে তা হবে আগ্নেয়গিরির মতো। কাজেই শাসকদের সাবধান হতে হবে। সাধারণ মানুষের চাহিদার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। কেবল মেগাপ্রকল্প কিন্তু রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে না।
শ্রীলঙ্কার মানুষ এখন বাঁচার পথ খুঁজছে। যদিও সেই পথের দিশা পাওয়া কঠিন। যে আইএমএফের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সরকার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেই আইএমএফ ঋণ এখন শ্রীলঙ্কার জন্য কার্যত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সেই ঋণের ওপর দাঁড়িয়ে এবং দ্রুত আর্থিক নীতির সংস্কার সাধন করে শ্রীলঙ্কা চরম সংকট থেকে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক বিষয়ে এই দেশের সামর্থ্য ঘুরে দাঁড়ানোর বড় পাথেয় হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রথম কাজ অবিলম্বে একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রশাসন তৈরি করা। স্থিতিশীলতা অনেক সাধনার ব্যাপার, কিন্তু আগে অস্থিরতা দূর করতে হবে।
শ্রীলঙ্কায় এখন সর্বদলীয় সরকার গঠনের যে উদ্যোগ চলছে, তা এই লক্ষ্য পূরণের পথে জরুরি পদক্ষেপ, কিন্তু প্রথম পদক্ষেপ। জনসাধারণের যথার্থ বিশ্বাস ও আস্থা ফিরে পেতে প্রয়োজন একটি সর্বদলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার, সমস্ত অঞ্চল, জাতি এবং বর্গের নাগরিকরা যার প্রকৃত অংশীদার হয়ে উঠবেন। অভূতপূর্ব সংকট থেকেই অভাবিতপূর্ব সমাধানের উপায় খুঁজে পাওয়া যায়। ইতিহাসে তার নজির আছে। শ্রীলঙ্কাতেও তেমনটা ঘটুক, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এটাই প্রত্যাশা।
লেখক লেখক ও কলামিস্ট/chiros234@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.