মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
গোনাহ এক ব্যক্তির কাজ, যা মহান আল্লাহর আদেশের অবাধ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্য কথায়, এমন কিছু করা যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন কিংবা আল্লাহ যা করতে আদেশ করেছেন তা পরিত্যাগ করা। আর দুর্নীতি হলো এমন এক পরিস্থিতি, যা সমাজের স্বাভাবিক গতিবিধিকে ব্যাহত করে। মানুষের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও জনশান্তি বিনষ্ট করে সমাজকে সংযমহীন করে তোলে। গোনাহ ব্যক্তি আচরণের কলুষতা এবং দুর্নীতি সমাজের কলুষতা। যা কোরআন মাজিদ উভয়ের মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ ও ব্যাপক সম্পর্ক টেনেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুণ বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ -সুরা আর রূম : ৪১
আয়াতটি মানুষের গোনাহ এবং দুর্নীতির মধ্যে বিস্তৃত সংযোগ দেখায়। গোনাহ এবং আইন ভঙ্গ অস্বাস্থ্যকর এবং বিষাক্ত খাদ্যের মতো। যা মানবদেহে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং মানুষকে এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার শিকার করে। উদাহরণস্বরূপ মিথ্যা, বিশ্বাস নষ্ট করে এবং বিশ্বাসঘাতকতা সামাজিক সম্পর্ক ব্যাহত করে, নিপীড়ন সর্বদা অন্য নিপীড়নের উৎসে পরিণত হয়।
গোনাহের প্রভাব মানুষকে নানাভাবে আবৃত করে। হাদিসে উল্লেখ আছে, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে মানুষের আয়ু কমে এবং এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ অন্তরকে অন্ধকার করে। হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারকারীদের জন্য ছয়টি কঠিন শাস্তি রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি দুনিয়াতে ও তিনটি আখেরাতে প্রকাশ পাবে। যে তিনটি শাস্তি দুনিয়াতে প্রকাশ পাবে তা হচ্ছে চেহারার উজ্জ্বলতা বিনষ্ট, আয়ুষ্কাল সংকীর্ণ এবং দরিদ্রতা চিরস্থায়ী হওয়া। আর যে তিনটি শাস্তি আখেরাতে প্রকাশ পাবে তা হচ্ছে সে আল্লাহর অসন্তোষ, কঠিন হিসাব ও জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।’ -বায়হাকি : ৫৬৪
পবিত্র কোরআন আমাদের স্পষ্টভাবে দেখায়, ব্যক্তির কাজ সমাজের অবস্থার ওপর গভীর এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব সৃষ্টি করে। তাই সমাজ সংস্কারের জন্য শুধুমাত্র কঠোর সামাজিক নিয়মের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না, বরং নির্দেশিকা এবং সচেতনতার মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের চেষ্টা করতে হবে। এজন্য বর্ণিত কোরআনের আয়াতটি গভীরভাবে অনুধাবন করা দরকার। উল্লিখিত আয়াতে ‘স্থল’ বলতে মানুষের বাসভূমি এবং ‘জল’ বলতে সমুদ্র, সামুদ্রিক পথ এবং সমুদ্র-উপকূলে বসবাসের স্থান বুঝানো হয়েছে। ‘ফাসাদ’ (বিপর্যয়) বলতে ওই সব আপদ-বিপদকে বুঝানো হয়েছে, যার দ্বারা মনুষ্যসমাজে সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হয় এবং মানুষের শান্তিময় জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। এজন্য এর অর্থ গোনাহ ও পাপাচরণও করা যেতে পারে।
অর্থাৎ, মানুষ একে অপরের ওপর অত্যাচার করছে, আল্লাহর সীমালঙ্ঘন করছে এবং নৈতিকতার বিনাশ সাধন করছে, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে। অবশ্য ‘ফাসাদ’-এর অর্থ ওই সব বিপর্যয় নেওয়াও সঠিক, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি ও সতর্কতাস্বরূপ প্রেরণ করা হয়। যেমন দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অনিরাপত্তা, ভূমিকম্প ও বন্যা ইত্যাদি। অন্য আয়াতে এই বিষয়বস্তু এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের যেসব বিপদাপদ স্পর্শ করে, সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের কারণে। অনেক গোনাহ তো আল্লাহ ক্ষমাই করে দেন।’ -সুরা আশ শুরা : ৩০
ইসলামি স্কলারদের মতে, যখন মানুষ আল্লাহর অবাধ্যতাকে নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিফলস্বরূপ তাদের কর্মপ্রবণতা মন্দের দিকে ফিরে যায় এবং পৃথিবী নানা বিপর্যয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, সুখ-শান্তি বিলীন হয় এবং তার পরিবর্তে ভয়-ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা, ছিনতাই-ডাকাতি, লড়াই ও লুটপাট ছড়িয়ে পড়ে। এর সঙ্গে কখনো আকাশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন আপদ-বিপদও (প্রাকৃতিক দুর্যোগ) প্রেরিত হয়। এর উদ্দেশ্য, ওই সর্বনাশী বিপর্যয় ও আপদ-বিপদ দেখে মানুষ পাপকর্ম থেকে বিরত হবে এবং আল্লাহর কাছে তওবা করে পুনরায় তার আনুগত্যের দিকে ফিরে আসবে।
এর বিপরীত যে সমাজের রীতিনীতি ও চালচলন আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, অত্যাচারের জায়গায় ন্যায়পরায়ণতা বিরাজমান, সেই সমাজে সুখ-শান্তি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ ও বরকত দেওয়া হয়। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন একজন পাপাচারী মারা যায়, তখন শুধু মানুষই নয়; বরং গ্রাম-শহর, গাছপালা এবং প্রাণীরা পর্যন্ত শান্তিলাভ করে।’ -সহিহ বোখারি
দুনিয়ার যাবতীয় বিপদাপদের কারণ মানুষের গোনাহ। যদিও দুনিয়াতে গোনাহের পুরোপুরি প্রতিফল দেওয়া হয় না এবং প্রত্যেক গোনাহের কারণেই বিপদ আসে না। বরং অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। দুনিয়াতে প্রত্যেক গোনাহর কারণে বিপদ এলে একজন মানুষও পৃথিবীতে বেঁচে থাকত না। ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি আল্লাহ লোকদের তাদের অন্যায় কাজের কারণে পাকড়াও করতেন, তবে ভূপৃষ্ঠে চলমান কোনো কিছুকেই ছাড়তেন না। কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুত সময় পর্যন্ত তাদের অবকাশ দেন। অতঃপর নির্ধারিত সময়ে যখন তাদের মৃত্যু এসে যাবে, তখন এক মুহূর্তও বিলম্বিত কিংবা ত্বরান্বিত করতে পারবে না।’ -সুরা আন নাহল : ৬১। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে ভূপৃষ্ঠে কোনো জীবজন্তুকেই রেহাই দিতেন না, কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদের অবকাশ দিয়ে থাকেন।’ -সুরা ফাতির : ৪৫
অর্থাৎ, মানুষের অনেক গোনাহ দয়াময় আল্লাহ নিজগুণে মাফ করে দেন। যেগুলো মাফ করেন না, সেগুলোরও পুরোপুরি শাস্তি দুনিয়াতে দেন না; বরং সামান্য স্বাদ আস্বাদন করান যেন মানুষ সংশোধন হয়। আর দুনিয়ার বিধান হলো, মানুষ যদি নিজে নিজেকে সংশোধন না করে, সংস্কার না করে, তাহলে সৃষ্টিজগৎ তাদের স্বাভাবিকভাবে এবং ঐশ্বরিক নিয়মে পরিমার্জিত করবে। তখন মন্দকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে আল্লামা তাবারি (রহ.) পবিত্র কোরআনের আয়াতের উল্লেখ করে বলেন, সৃষ্টি ব্যবস্থায় মিথ্যা, অন্যায়, পাপাচার, অনাচার টিকে থাকে না। কারণ কোরআন মাজিদে (সুরা মায়েদা : ৫১) বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ অবিবেচকদের পথপ্রদর্শন করেন না।’ আর দুনিয়ার বুকে গোনাহে লিপ্ত, দুর্নীতিতে মত্ত এবং পাপাচারে আসক্তদের চেয়ে অবিবেচক কারা আছে?
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.