মামুনুর রশীদ:
হিসাব করে দেখলাম আজ থেকে আটান্ন বছর আগে এই ঢাকা শহরে এসেছিলাম। ছাত্রাবস্থায় সকালের নাস্তা খরচ দুটো পরোটা চার আনা, দু’আনার মাংস, দু’আনায় এক কাপ চা। আট আনাতেই সকালের নাস্তাটা হয়ে যেত। বাকি দু’বেলা হোস্টেলে খাওয়া, সেখানে দিতে হতো পঁয়ত্রিশ টাকা। এই পঁয়ত্রিশ টাকার মধ্যে আবার মাসে একবার ফিস্ট একবার ইমপ্রুভড ডায়েট। এই ব্যবস্থা চলেছে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। সেটাও খুব উঁচু মানের। এসব কথা আজকের তরুণদের কাছে বললে তারা বিশ্বাস করে না, বরং গল্পকথা বলে উড়িয়ে দেয়।
সতেরশ সালে এই শহরে এক টাকা থাকলেই পরিবার-পরিজন নিয়ে মোটামুটি মাস কাবার হয়ে যেত। এগুলো আমাদের কাছে গল্পকাহিনী নয়। সতেরশ সাতান্ন সালে টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত। কিন্তু ব্রিটিশের লুণ্ঠনের ফলে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ে এক টাকায় মাত্র ছয় সের চাল পাওয়া গেল। ঐ সময়ে দুর্ভিক্ষে এত লোক মৃত্যুবরণ করেছিল যে তৎকালীন ঢাকার লোকসংখ্যা সতেরশ সালে যেখানে দশ লাখ ছিল আঠারো শ’ সালে সেখানে পঞ্চাশ হাজার হলো। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ঢাকার জনসংখ্যা আবার বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই বাড়াটাও বেশ সহনশীল। সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হওয়াতে জনসংখ্যা একটু বাড়ল, অনেকটা একটা বড় মফস্বলের মতো। কিন্তু জনসংখ্যা স্ফীত হতে শুরু করল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে।
ঢাকামুখী মানুষের স্রোত আর থামল না, এখন যদিও সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবুও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ মিলে জনসংখ্যা আড়াই কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা আয়তনে যে খুব একটা বেড়েছে তা নয়, তাই এই জনসংখ্যার চাপ প্রথমে গিয়ে পড়েছে বাড়ি ভাড়ার ওপর। সত্তরের দশকের পর থেকেই বাড়ি ভাড়া বাড়তে থাকে। কখনো লাফিয়ে লাফিয়েও তা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে মানুষগুলো ঢাকা শহরের কেন্দ্রে অবস্থান করত তারা চলে যায় দূরে, আর যারা প্রান্তিক মানুষ ছিল তারা হটে যায় ঢাকার বাইরে এবং কেউ কেউ আশপাশের বস্তিতে। এর মধ্যে এক দোতলা তিনতলা চারতলা বাড়িগুলো ভাঙা শুরু হয়, আসে অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসা। নগর পরিকল্পনাহীনভাবে জিম্মি হয়ে পড়ে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের হাতে।
গত চল্লিশ বছরে শহরটা একটা গুচ্ছ দিয়াশলাই বাক্সে পরিণত হয়েছে। শুধু ঢাকা শহর নয়, সারা দেশের শহরগুলোই এখন গুচ্ছ দিয়াশলাই বাক্সের আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে নাভিশ্বাস উঠে গেছে শহরবাসীর। বাসা ভাড়া বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে। সরকারি-আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন তারা বেতনের চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ভাগ বাড়ি ভাড়া পান। তারপর যে টাকাটা থাকে তা দিয়ে সন্তানের পড়ালেখা, যাতায়াত খরচ, কাঁচাবাজার, শুকনো খাবার কেনাসহ জামাকাপড় কেনাকাটা এসবে ব্যয় হয়ে যায়। গত কভিড-১৯ এর সময় দেখা গেল অনেক জায়গায় যখন কাজের বেতন কমে গেল বা লোকবল ছাঁটাই করা হলো তখন এসব মানুষ গ্রামে ছুটতে শুরু করল। গ্রামে কোনো জীবিকা নেই, একসময় সুশীতল বাতাস ছিল, বরষায় বৃষ্টি ছিল এখন তাও নেই। বর্ষাকে মনে হয় শরৎকাল এবং শরৎকাল বলে এখন আর কোনো ঋতুর অস্তিত্ব নেই। যারা গ্রামে চলে গিয়েছিলেন তাদের ছেলেমেয়ের পড়ালেখা নষ্ট হলো, ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে আবার এক সময় মানুষগুলোকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করতে হলো। সেও এক অনিশ্চিত পথের যাত্রা। এরই মধ্যে করোনার প্রকোপ একটু কমতে না কমতেই আবার হানা দিচ্ছে করোনা।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই দেখা গেল দুটি বড় ঈদ বড় ধরনের আশীর্বাদ দিয়ে গেছে তা হলো সব দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি। সব ব্যবসায়ীরা সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আবার যুদ্ধ লেগে আছে রাশিয়া-ইউক্রেনের। ইউক্রেন কতদূর, এখান থেকে গোলা-কামানের শব্দও শোনা যায় না। কিন্তু কামান দাগছে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ সব জিনিসপত্রের দামে। আর সেই সঙ্গে একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা চলছে। একটা নিষ্প্রদীপ মহড়ার মতো লোডশেডিং। সব কিছুই মহৎ সিন্ডিকেটের হাতে! যুদ্ধের ফলাফল এত দ্রুত বাংলাদেশে এসে পৌঁছাল যে, ইউরোপের কাছাকাছি দেশগুলোতেও তখন এরকম শুরু হয়নি। এত বুদ্ধিমান হাজি সাহেবরা খাতুনগঞ্জে, চকবাজারে বসে বসে হিসাব-নিকাশ করে ফেলল। তাদের মওকা মিলে গেছে, আর চিন্তা নেই। আমাদের চাল, মুলা, বেগুন, শাকসবজি এগুলো কি ইউক্রেন থেকে আসে? আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা এই যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের নামও জানত না। কিন্তু এখন ইউক্রেন তাদের মুখে মুখে। ব্যবসায়ীরা সকাল-বিকেল প্রার্থনা করে যাচ্ছে এই যুদ্ধ যেন শেষ না হয়।
এদিকে আবার ঘটে গেল শ্রীলঙ্কা কান্ড। শ্রীলঙ্কা অপেক্ষাকৃত বাংলাদেশের কাছাকাছি। তাই যুদ্ধটা ইউক্রেন থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আরও তীব্র হয়ে উঠল। যুদ্ধটার পরিধি বাংলাদেশের বাজার। কাঁচাবাজারে যে লোকটা ভ্যানের ওপর কাঁচাবাজার সামগ্রী বিক্রি করে সেও ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দেয়। বেগুনের দাম আশি টাকা, কাঁচামরিচ দুইশ টাকা এমনি করেই শাকসবজিসহ সব কিছুর দাম তিনগুণ হয়ে গেছে। হালকা পানীয় দশ টাকা থেকে একলাফে বিশ টাকা হয়ে গেছে অবলীলায়। একদিনে কয়েক কোটি মুনাফার সুযোগ পেয়ে গেছে তারা। বড় খেলাটা খেলে সয়াবিন তেলে। এক লাফে একশ টাকা বেড়ে গেল লিটারপ্রতি। সরকার ও ক্রেতাদের চাপে লিটারপ্রতি কমল মাত্র চৌদ্দ টাকা। বাংলাদেশের বাজার ব্যবসায়ীদের জন্য একটা সোনার টুকরা। একবার বেড়ে গেলে সেটার দাম আর কমে না।
এখন আবার আওয়াজ উঠেছে লোডশেডিংয়ের। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না পেয়ে কলকারখানায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে তাই পণ্যের দাম বাড়াতেই হবে। ব্যবসায়ীরা যেহেতু জানে সংসদ এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ব্যবসায়ীদের হাতে তাই সরকারের কথা তারা তোয়াক্কা করে না। রাত ৮টায় দোকান বন্ধ হওয়ার কথা কিন্তু চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে দোকানদাররা। তেল-গ্যাস বা বিদ্যুতের সাশ্রয়ের কথা যেটা সরকার বলছে সেগুলোও তারা শুনছে না, অবৈধ সংযোগ চলছে যথারীতি পুরোদমে। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেই।
নিরাপদে আছে সরকারি দলের সঙ্গে যারা রাজনীতি করে তারা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যাদের বাজার করতে হয় না তারা এবং ব্যবসায়ী আর মাদক ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তারা সংখ্যায় কত? মোট জনসংখ্যার বড়জোর দশভাগ, বাকি নব্বইভাগের অবস্থাটা কী? তাদের অবস্থা নিয়ে ভাববার লোকই-বা কোথায়? এখন মানুষ কার কাছে যাবে? সংসদ সদস্য, মেয়র, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, সরকারি কর্মকর্তা থেকে তাদের দূরত্ব যোজন যোজন মাইল দূরে। দোকানদার, ব্যবসায়ী তারা থাকেন বড়ই নিরাপদে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায়।
আর এই যে হতভাগ্য পাবলিক, তাদের ওপর চড়াও হয়ে আছে সবাই। পরিবহনের গু-ারা ইচ্ছামতো ভাড়া বৃদ্ধি করে। গত পরশু দিনও উচ্চ ভাড়া নিয়ে একই বাসে তেরো জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকা- থামছেই না। পত্রিকাতেই আছে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পরিবহন নেতা, যারা অছাত্র এবং বিবাহিত। তারা বরিশাল মহানগরে সানগ্লাস পরে মোটরসাইকেল নিয়ে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় এবং সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। যে কোনো দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে প্রতিদিন যুক্ত হয় কিছু বখরা। যেমন ফুটপাতের দোকানদারের কাছ থেকে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য টাকা লাগে, দোকান বসানোর জন্য টাকা লাগে এবং দাম বাড়ানোর জন্যও কিছু বখরা দিতে হয়। আর এসব অর্থ যুক্ত হয় দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে। রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সরকারি আমলা সবাই তা জানে। কিন্তু তারা যে অবৈধ অর্থনীতিটাকে গড়ে তুলেছে তাকেই রক্ষা করে চলেছে। আমাদের দেশের মতো এত সুশীল ভোক্তা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সে এক বড় ধরনের গোপাল, যা পায় তাই যে কোনো মূল্যে কিনে নেয়। টাকা কম থাকলে কম কিনে, কম খায়।
এর মধ্যে আছে কিছু বাড়তি আয়। কোথাও একটা দাঙ্গা বাধাতে পারলে, বিশেষ করে তা যদি সাম্প্রদায়িক হয় তাহলে তো কথাই নেই। ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে যারা স্লোগান দেয় তারাই রাতের অন্ধকারে হিন্দুদের বাড়িতে গিয়ে বলে টাকা দাও, নইলে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেব। যাদের টাকা আছে তাদের বাড়ি রক্ষা পায় আর যাদের টাকা নেই তাদের বাড়িটা দখলে চলে যায়। যারা এসব কা-ের উসকানিদাতা তারা রক্ত খাওয়া দলটির সঙ্গে যুক্ত। ওয়াজ মাহফিল করে বিদ্বেষ জাগিয়ে এরাও একটা বখাটে।
আর দেশের এই সব কিছুর বিপরীতে মানুষ এখন বোবা এবং বধির। এই বোবা-বধির মানুষরা কখনো যে মহাশক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে না তা নয়। তার প্রমাণ আমরা অতীতে দেখেছি। তাই রাষ্ট্রকে এই মুহূর্তেই একটা বার্তা দেওয়া প্রয়োজন। লেখক নাট্যকার, অভিনেতা ও কলামিস্ট
mamunur530@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.