মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
আল্লাহতায়ালা আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তিনিই রিজিকদাতা, পালনকর্তা, আইনদাতা, বিধানদাতা, হেফাজতকারী ও আমাদের পরিচালক। আমরা যদি আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে নিই তাহলে এসব বিষয় অকপটে স্বীকার করতে হবে, এটাই ইমান। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য জায়গায় আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ‘তিনি ছাড়া কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই’, তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সুরা বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তো আল্লাহ, এমন এক চিরঞ্জীব ও চিরন্তন সত্তা যিনি সমগ্র বিশ্বজাহানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (উপাস্য) নেই। তিনি ঘুমান না, তন্দ্রাও তাকে স্পর্শ করে না।’
সুরা হাশরের শেষ আয়াতে তার স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। সুরা বাকারার শেষ তিন আয়াতে মহান প্রভুর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সুরা ইখলাসে একত্ববাদের পরম পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। কোরআন মজিদের উল্লিখিত আয়াতগুলো যে কেউ পড়লে আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য এবং একত্ববাদের ঘোষণা দিতে নিজ মনকে সাব্যস্ত করবে। যে মহান সত্তাকে আমরা স্রষ্টা হিসেবে মেনে নিলাম তার সব হুকুম-আহকাম মেনে চলা আমাদের জন্য আবশ্যক। আল্লাহতায়ালা রুহের জগতে মানুষকে সৃষ্টি করা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দুটি চুক্তি করেছেন। একটি রুহের জগতে অন্যটি দুনিয়ায়। মহান আল্লাহর সঙ্গে বান্দার চুক্তি কতই না সুন্দর। কত তাৎপর্যময়, কত অর্থবহ তা দেখলেই বোঝা যায়।
আল্লাহতায়ালার সঙ্গে বান্দার চুক্তি প্রথম সম্পাদিত হয় রুহের জগতে। আলমে আরওয়াহে (রুহের জগৎ) আল্লাহতায়ালা সব আত্মাকে তৈরির পর তাদের সামনে প্রশ্ন রাখেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’ সব আত্মা তথা আমরা সবাই বলেছিলাম হ্যাঁ, (আপনি আমাদের প্রভু) আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি। আল্লাহতায়ালার সঙ্গে এই চুক্তির মাধ্যমে আমরা মেনে নিয়েছি, তিনি আমাদের প্রভু। এ স্বীকারোক্তির অর্থ হলো, দুনিয়ার সব বিষয়ে সব জায়গায় তার সিদ্ধান্ত মানতে হবে। জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে তার নিয়মের বাইরে আর কোনো নিয়ম অনুসরণ করা যাবে না।
মহান আল্লাহর সঙ্গে বান্দার দ্বিতীয় চুক্তিটি হয়েছে দুনিয়ায় এসে। সুরা তওবার ১১১ নম্বর আয়াতে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। যাতে তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে। তারা মরে এবং মারে।’ এই চুক্তি দ্বারা একটা অকাট্য সত্য কথা প্রমাণিত হয়, যে জীবন নিয়ে আমরা চলাফেরা করি এটা মূলত আমাদের না। আবার যে সম্পদ নিয়ে আমরা বাহাদুরি করি, গর্ববোধ করি এগুলোও আমাদের না। এগুলো আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। আমাদের যা রয়েছে তা হলো জান্নাত, সেটাই স্থায়ী নিবাস। সেহেতু এই জীবন ও সম্পদ নিয়ে বাহাদুরি না করে সেই জান্নাত পানে ছুটে চলা উচিত। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা এই জান-মাল নিয়ে বেশি চিন্তা করি, পেরেশান থাকি। এটার পেছনে বেশি দৌড়াই। অথচ এটা আমাদেরই না। সুরা মুনাফিকুনের ৯ নম্বরে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যাতে তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে ফিরিয়ে না রাখে।’
এখন প্রশ্ন হলো, মাল-সম্পদ এবং জীবন আল্লাহ কিনে নেওয়ার পর আবার কেন আমাদের কাছে রেখেছেন? পৃথিবীর কোথাও কি কোনো ক্রেতা কোনো বস্তু কিনে নেওয়ার পর আবারও তা বিক্রেতাকে ফেরত দিয়েছে অথবা ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে? কিন্তু দয়াময় আল্লাহ এটা করেছেন। মানুষের জান-মাল কিনে নিয়ে আবারও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু কেন? এর রহস্য কী?
এর উত্তর জানতে হলে আমাদের সুরা মুলকের ২ নম্বর আয়াতে যেতে হবে। সেখানে তিনি বলেন, ‘তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন। যাতে করে তিনি পরীক্ষা করে নিতে পারেন কে কত উত্তম আমল করে?’ এর মানে, আল্লাহ দেখে নিতে চান স্বাধীনতা পেয়েও কে কত ভালো আমল করে। আমার দেওয়া আমানত জীবন ও সম্পদ পেয়ে কে যথাযথ ব্যবহার করে, আবার কে খেয়ানত করে। দুনিয়ায় দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি কারও কাছে কিছু আমানত রাখলে সেটার ব্যবহার তার মালিকের অনুমতি এবং মর্জি মতোই করে। তার মর্জির বাইরে গিয়ে তার রেখে যাওয়া আমানতের কোনোরূপ ব্যবহার করতে পারে না। এটা মানুষের স্বভাবসিদ্ধ হতে পারে না। কিন্তু আমরা লক্ষ করি, আল্লাহ যেভাবে বলেছেন সেভাবে আমরা জীবন এবং সম্পদকে কাজে লাগাতে পারি না। বহুক্ষেত্রেই আল্লাহর দেওয়া আমানতের খেয়ানত করে ফেলি। কৃত চুক্তি ভেঙে ফেলি, পাপের কাজে জড়িয়ে যাই, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আল্লাহতায়ালার সঙ্গে যেহেতু বান্দার উপরোক্ত দুটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে বলা যায়, তিনি আমাদের প্রভু এবং আমাদের জান-মাল মূলত তার। সুতরাং চুক্তির সংজ্ঞানুযায়ী জীবন পরিচালনার সবক্ষেত্রে সর্বজনীন এবং সর্বজনীনভাবে আল্লাহর হুকুম ও বিধান মেনে চলা একান্ত কর্তব্য। এই দাবি থেকেই মহান আল্লাহ সুরা বালাদের ৮-১০ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের দুটি চক্ষু দিইনি? একটি জিহ্বা এবং দুটি ঠোঁট দিইনি? বস্তুত আমি তোমাদের দুটি পথপ্রদর্শন করেছি।’ অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা মানুষকে ভালো ও মন্দ, ইমান ও কুফর, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের পথ দেখিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘আমি মানুষকে পথের নির্দেশ দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে; না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে।’ সুরা দাহার : ৩
প্রকৃত মুসলমানের দায়িত্ব হলো, আল্লাহর সঙ্গে কৃত চুক্তি সার্বিকভাবে পালিত হচ্ছে কি না তা চিন্তা করা। তা ছাড়া এই চুক্তি ভালোভাবে আমরা যেন পালন করতে পারি এবং ভুলে না যাই সেজন্য আল্লাহতায়ালা মাঝে মাঝে পরীক্ষা করবেন। তিনি কোরআন মজিদে বলেন, ‘আমি তোমাদের পরীক্ষা করব ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি করে।’ সুরা আল বাকারা : ১৫৫
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.