ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
সুলভ প্রোটিনের উৎস হিসেবে অধিকাংশ পরিবারের দৈনিক খাদ্যতালিকায় থাকা ডিমের দাম নিয়ে তেলেসমাতি চলছেই।
এক মাস আগে ডিমের দাম বাড়ানোর অজুহাত ছিলো ডিজেলের দাম বৃদ্ধি। এছাড়া ডিম উৎপাদনকারী বড় ফার্মগুলো কমিশন এজেন্ট ও নিলাম প্রক্রিয়ায় নিজেদের নিয়োগকৃত এজেন্ট ব্যবহার করেও ডিমের দাম বাড়ানোর ফায়দা কুড়িয়েছে।
এরপর জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান এবং জনসচেতনতার কারণে ডিমের দাম কমেছিলো। কিন্তু গত ৫ দিন ধরে আবারো ডিমের দাম ঊর্ধ্বমুখী।
এবার ডিমের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে- বাড়তি ফিডের দাম, বাড়তি পরিবহন ভাড়া এবং মুরগির বাচ্চার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি।
রাজধানীর কয়েকটি কাঁচাবাজার সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং খাতসংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ৫ সেপ্টেম্বর এক ডজন ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ছিল ১২০ টাকা। ৮ সেপ্টেম্বর সেই দাম বেড়ে হয় ১৩০ টাকা। পরদিন এটি বেড়ে হয় ১৪০ টাকা। আর আজ (শনিবার) খুচরা বিভিন্ন দোকানে ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৪২ থেকে ১৪৪ টাকায়।
সাম্প্রতিক সময়ের মতো ডিমের বাজার এমন অস্থিতিশীল গত কয়েক বছরে ছিল না। প্রায় ১ দশক আগে বার্ড ফ্লু মহামারির সময় সর্বশেষ ডিমের দাম বেড়েছিলো।
গত ৯ আগস্ট থেকে ডিমের দাম বাড়তে শুরু করে। যা ১৩ আগস্ট রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। ১৮ থেকে ২৪ আগস্টের মধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) দেশজুড়ে ডিম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযান চালায়। অভিযানে ডিমের বাজারে সিন্ডিকেটের কারসাজির বিষয়টি পরিষ্কার হয়। এরপর বাজারে ডিমের দাম কমতে শুরু করে। ডজন নেমে আসে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। তবে এই স্বস্তি ছিল ক্ষণস্থায়ী। মাস পার না হতেই আবারো প্রতি ডজন ডিমে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে গেছে।
জানা গেছে, কেবল গত ছয় মাসের ব্যবধানে প্রতি বস্তাতে ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির খাদ্যের দাম বেড়েছে ১১শ থেকে ১৫শ টাকা পর্যন্ত। অন্যদিকে প্রতিটি মুরগির বাচ্চার দাম বেড়েছে ২৪ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া সম্প্রতি ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। ইতোমধ্যে খামারের পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে অনেক ছোট খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।
পোল্ট্রি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ছয় মাস ৫০ কেজি ব্রয়লার মুরগির খাদ্যের দাম ছিল ১৬শ টাকা। বর্তমানে সেই বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৭শ টাকায়। এছাড়া লেয়ার মুরগির খাদ্যের বস্তাপ্রতি দাম ছিল ১৮শ টাকা। বর্তমানে সেই বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩৩শ টাকায়। প্রতিটি একদিনের মুরগির বাচ্চার দাম ছিল ১৫ থেকে ১৮ টাকা, এখন কিনতে হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকায়। অন্যদিকে মুরগির বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ওষুধের দামও বেড়েছে দ্বিগুণ।
পাইকারি ও বড় আকারের ব্যবসা পরিচালনাকারী খামারিরা জানান, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতি থাকার কারণেই দাম বাড়ছে।
খুচরা ডিম ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে মুরগির খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। এ জন্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন খামারিরা। ফলে মুরগির উৎপাদন ও সাপ্লাই কম থাকায় দাম বেড়েছে। পাইকারিতে ডিমের দাম বাড়ায় বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ বলেন, করোনা মহামারির সময় লকডাউনে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হন, যার প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। দৈনিক চাহিদা অনুযায়ী ডিম উৎপাদিত হচ্ছে না। এ কারণেও ডিমের দাম বাড়ছে। এছাড়া ফিড, ওষুধ আর ভাড়া বাড়ার কারণ তো রয়েছেই।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট জ্বালানির দাম বাড়ার পর অনেক ট্রাকচালক ২ থেকে ৩ দিন কোনো পণ্য পরিবহণ করেননি। সে সময় ট্রাকচালক ও মালিকরা সরকারের সঙ্গে নতুন পরিবহন ভাড়া নিয়ে আলোচনা করে। ওই সময় ঢাকায় কোনো ডিমবাহী ট্রাক প্রবেশ করতে না পারায় চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে একটি ব্যবধান তৈরি হয়। এছাড়া গত কয়েকমাসে খামারিরা ডিমের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। সবকিছুর প্রতিফলন ঘটেছে এ মাসের মূল্যবৃদ্ধিতে।
তবে এই অজুহাত মানতে নারাজ সাধারণ ক্রেতারা।
বাংলাদেশ ডিম উৎপাদক সমিতির মতে, দেশে দৈনিক সাড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি ডিমের চাহিদা রয়েছে। ডিমের একটি বড় অংশ আসে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা খামারগুলো থেকে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ডিম উৎপাদন হয়েছে। আগের দশকের তুলনায় উৎপাদন প্রায় ৩ গুণ হয়েছে।
দাম বাড়ে বড় উৎপাদনকারী ফার্মের কারসাজিতে:
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিআরপি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আগস্ট মাসে ডিম উৎপাদনকারী বড় ফার্মগুলো কমিশন এজেন্টের মাধ্যমে মূল্য কারসাজি ও নিলাম প্রক্রিয়ায় নিজেদের নিয়োগকৃত এজেন্ট ব্যবহার করে ডিমের দাম বাড়ায়। গত ১৮ থেকে ২৪ আগস্ট দেশব্যাপী ডিম ও ব্রয়লার মুরগির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে অধিদপ্তর। অভিযান থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতেই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংস্থাটি। এতে বলা হয়েছে, ডিম ও লাইভ চিকেনের ক্ষেত্রে মূল্য কারসাজির মাধ্যমে কতিপয় বড় ফার্ম ও মধ্যস্বত্বভোগী লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শত শত প্রান্তিক খামারি ও সাধারণ ভোক্তা।
এতে আরও বলা হয়েছে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ডিমপ্রতি পরিবহন ব্যয় ৩ থেকে ৪ পয়সা বেড়েছে। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ডিমপ্রতি দাম বাড়িয়েছে ২ টাকা ৭০ পয়সা। আর ব্যবসায়ীরা ক্রয়-বিক্রয় রশিদ সংরক্ষণ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করায় ভোক্তারা প্রতারিত হয়েছেন।
সংস্থাটির মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সই করা প্রতিবেদনটিতে কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে গত ৩০ আগস্ট তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এদিকে বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোহসিন বলেন, পোল্ট্রি সেক্টরে নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। বড় কোম্পানিগুলোর বিষয়ে একটি নীতিমালায় আসা উচিত। না হলে একসময় ক্ষুদ্র পোল্ট্রি খামারিরা নিঃস্ব হয়ে পড়বে। আর কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে যাবে কোটি জনগণ। তখন তাদের বেঁধে দেওয়া দামেই ডিম-মুরগি কিনতে হবে।
তিনি বলেন, পোল্ট্রি খাদ্য তৈরির কাঁচামাল সয়াবিনসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। শুধু বর্তমানে ভুট্টার দাম কিছুৃটা কমেছে। সেক্ষেত্রে প্রডাকশন কমে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে আমাদের ওপর। খাদ্যের মানও আগের মতো নেই। ডিম কম পাওয়া যাচ্ছে। ইউরোপ ও চীন থেকে মূলত এসব পণ্য আমদানি করতে হয়। সেখানেই দাম বেড়েছে তাই খাদ্যের দামও বেড়েছে। এসব যেন সরকার এবং নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকে সে বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ জরুরী।
ভয়েস/জেইউ।
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.