চিররঞ্জন সরকার:
আগস্ট পেরিয়ে সেপ্টেম্বরের শুরু সাধারণত আমাদের দেশে এই সময়টায় ডেঙ্গু ম্যালেরিয়া রোগের মাহেন্দ্রক্ষণ। কয়েক বছর ধরেই এই ট্র্যাডিশন চলছে। রুটিনমতোই ঢাকা ও সংলগ্ন জেলাগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে, এবারেও বাড়ছে। রাজধানীর সর্বত্রই বেড়েছে এডিস মশার বিস্তার। বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন নতুন নতুন রোগী। অনেকেই বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরকারি হিসাবে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৯৫১ জন। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ রোগী ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা। এদিকে গত আগস্ট মাসে ৩ হাজার ৫২১ জন ডেঙ্গু রোগী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও চলতি মাসের প্রথম ৮ দিনে বিভিন্ন হাসপাতালে ১ হাজার ৭৭০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ সময়ে মারা গেছেন ১০ জন। এ ছাড়া আগস্টে মারা গেছেন ১১ জন, জুলাইয়ে ৯ জন ও জুনে ১ জন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হিসাবের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এখনো ডেঙ্গু নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছেন না। রোগপ্রতিরোধের কোনো উদ্যোগ তো নেই-ই, রোগ নিরাময় বিষয়েও তারা নিতান্ত উদাসীন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্লাডব্যাঙ্কে নেই নেই পর্যাপ্ত রক্ত। আগামী কয়েক মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেলে প্লেটলেটের চাহিদাও অনেক গুণ বাড়বে। হেমোরেজিক ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্লেটলেট পাওয়া বা না-পাওয়া আক্ষরিক অর্থেই রোগীদের জীবন-মরণের প্রশ্ন।
আমাদের দেশে ডেঙ্গুর চরিত্র প্রতি বছর এক থাকে না। কোনো বছর জুলাই থেকে রোগের সংখ্যা বাড়তে থাকে, আবার কখনো সংক্রমণ ভয়ংকর রূপে পৌঁছতে নভেম্বর মাস এসে পড়ে। ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়া বছরের যে সময়েই চরম স্তরে পৌঁছাক না কেন, তার জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। তার একটি দিক হলো রক্ত ও প্লেটলেটের জন্য রক্তদান শিবিরের আয়োজন। করোনা মহামারীর সময় থেকেই দেশে রক্তদান শিবির আয়োজনের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমেছে। এই শিবিরের আয়োজন মূলত সামাজিক উদ্যোগের প্রশ্ন, ফলে একবার তাতে ভাটা পড়লে আবার গতিবৃদ্ধি করা কঠিন হয়। এই সময়টিতে রক্তের ঘাটতি মেটাতে সরকারি উদ্যোগে শিবিরের সংখ্যাবৃদ্ধি প্রয়োজন।
এ বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি সবচেয়ে কম। যদিও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ওষুধ ছিটানো এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মতো নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলছে। কিন্তু সেসবের কার্যকারিতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে মশা মারার ওষুধ আনা এবং বিতরণ নিয়ে নানারকম সমালোচনাও রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, মশার ওষুধ ছিটানো হয় কেবল প্রধান সড়কের আশপাশে। কিন্তু বিভিন্ন গলি, দুই বাসার আনাচে-কানাচে, আরও নানা ধরনের দুর্গম স্থানে যেখানে ওষুধ ছিটানোর দায়িত্বে থাকা কর্মীরা সহজে পৌঁছাতে পারেন না, সেখানে নিরাপদে এডিস মশা বংশবৃদ্ধি করতে থাকে।
সিটি করপোরেশন সঠিক সময়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় ও উপযুক্ত কীটনাশক ব্যবহার না করায় ঢাকায় ভয়াবহ আকারে ডেঙ্গু বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কাজটি অবশ্যই সিটি করপোরেশনকেই করতে হবে। কিন্তু তারা সেই কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করতে পারছে না। সিটি করপোরেশন যে ফগিং করে সেটি ত্রুটিপূর্ণ। তা ছাড়া তাদের লোকবল ও কর্মীদের দক্ষতা নিয়েও সন্দেহ আছে। তাদের অধিকাংশ কাজ ত্রুটিপূর্ণ। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। দেশের যারা স্বীকৃত কীটতত্ত্ববিদ আছেন, তাদের পরামর্শও শোনা হয় না। সরকারের দিক থেকে পরিকল্পিত উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। কারণ এডিস মশা তাৎক্ষণিককভাবে নির্মূলকরণের ব্যাপার নয়। সারা বছর ধরে এডিসের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। আমাদের দেশে পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায় না। কীটনাশক প্রয়োগ এবং ডেঙ্গু ঠেকাতে নাগরিকদের যুক্ত করার ক্ষেত্রেও কোনো উদ্যোগ নেই। এ ক্ষেত্রে কাউন্সিলরদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে না। এই কাজে রাজনৈতিক দলের কর্মীদেরও ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের। কেবল সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর জন্য স্থানীয় নাগরিকদের যুক্ত করতে হবে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেও তৈরি থাকতে হবে ডেঙ্গুর প্রাবল্য মোকাবিলার জন্য। হাসপাতালে যথেষ্ট সংখ্যক শয্যার ব্যবস্থা, ডেঙ্গুর রক্তপরীক্ষার পরিমাণ বৃদ্ধি, যাতে যত বেশি সম্ভব রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব চিহ্নিত করে যথাযথ চিকিৎসার অধীনে নিয়ে আসা যায়, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালানো, প্রয়োজনে রোগীকে হাসপাতালে রেখে সুসংহত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
ডেঙ্গু শুধু বাংলাদেশে হচ্ছে না, আরও বহু দেশেই হচ্ছে। ডেঙ্গুজ্বর হওয়া সরকারের ব্যর্থতা নয়, ব্যর্থতা হলো তার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল, তা না করা। গত বছরই বিভিন্ন সংস্থা থেকে এডিস মশা বৃদ্ধির ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছিল, কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আসলে দেশের মানুষের জীবন ও দুর্ভোগ নিয়ে দায়িত্ববোধ বা জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকলে পরিস্থিতি এ রকম হতো না। এ ব্যাপারে সরকার ও সিটি করপোরেশনকে গা-ঝাড়া দিয়ে মাঠে নামতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, অন্য জীব দিয়ে এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ, কীটনাশক হিসেবে লার্ভি সাইড ও অ্যাডাল্টি সাইডের প্রয়োগ এবং জনগণকে এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ এই চারটি পদ্ধতি সারা বছর ধরে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও অঙ্গীকার প্রয়োজন।
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
chiros234@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.