মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘যেসব লোক বলে, (মহান) আল্লাহ আমার রব এবং তার ওপর অটল থাকে, নিঃসন্দেহে তাদের জন্য ফেরেশতা নাজিল হয় এবং তাদের বলতে থাকে, ভয় পেয়ো না, চিন্তা করো না। আর সেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে খুশি হও, তোমাদের কাছে যার ওয়াদা করা হয়েছে। আমরা এই দুনিয়ার জীবনে তোমাদের সঙ্গী, পরকালেও সেখানে তোমাদের মন যা চায়, তা তোমরা পাবে। আর যে জিনিস তোমরা দাবি করবে, তাই তোমাদের দেওয়া হবে। এটাই হলো মেহমানদারির সামগ্রী, সেই মহান আল্লাহর তরফ থেকে, যিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল এবং দয়াবান।’ -সুরা হা-মিম আস সাজদা : ৩০-৩২
সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহকে ‘রব’ বলে গ্রহণ করে তার ওপর আমরণ অটল থাকার কাজটি খুব সহজ নয়। আরবি ভাষায় এমন অনেক শব্দ আছে, যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ব্যাপক। যেমন রব, এই শব্দের হুবহু বাংলায় কোনো প্রতিশব্দ নেই। নানা সময় এর অর্থ করা হয়েছে অস্তিত্বদানকারী, প্রভু, প্রতিপালক, মনিব, সংরক্ষক, পরিচালক, আইনদাতা, হুকুমকর্তা, শাসনকর্তা, রাজা, বাদশাহ, সর্বময়কর্তা, মালিক, বলপ্রয়োগের অধিকার আছে যার, নেতা, সর্দার, যার নির্দেশে চলে, যার কর্র্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়, যিনি মূল ভূমিকা পালন করেন, তত্ত্বাবধায়ক, জিম্মাদার, প্রার্থনা শ্রবণকারী, প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহকারী হিসেবে।
সবাই জানি, মানুষকে দুনিয়ায় পাঠানোর আগেই (রুহের জগতে) মহান আল্লাহ প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমি কি তোমাদের রব নই?’ (সুরা আরাফ: ১৭২) তখন আমরা সবাই আল্লাহকে রব মেনে নিয়েই পৃথিবীতে এসেছি। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সর্বপ্রথম ‘রব’ শব্দ দ্বারা নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহতায়ালার যিনি সব সৃষ্টিজগতের পালনকর্তা।’ -সুরা ফাতিহা : ১
তদ্রƒপ কোরআনে কারিমের সর্বশেষ সুরায় ‘রাব্বিন্নাস’ অর্থাৎ ‘মানুষের রব আল্লাহর কাছে আশ্রয় লাভের’ কথা বলা হয়েছে। কবরে মানুষকে আল্লাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে ‘রব’ শব্দ দ্বারা। বলা হবে, ‘মার-রাব্বুকা’, তোমার প্রতিপালক কে? এভাবে জীবনের পরতে পরতে মহান রবের কথা মনে রাখার জন্য কোরআন মাজিদে রব শব্দটি ৯৭৮ বার ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজে (নফল নামাজ বাদে) যদি রুকু-সিজদা তিনবার করে তাসবিহ পড়ি তারপরও ২৮৮ বার আল্লাহকে রব বলে আমরা স্বীকার করি। এসবই মহান আল্লাহকে রব স্বীকার করে তার ওপর স্থির থাকার লক্ষ্যে, মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার নানা উপলক্ষ।
দয়াময় আল্লাহকে রব স্বীকার না করার কারণে বিভিন্ন দেশে অতীতে বিভিন্ন ভূখণ্ডে ভয়াবহ আজাব নাজিল হয়েছে। এ জাতীয় অনেকগুলো ঘটনা কোরআন মাজিদে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে রবকে স্বীকার করে এর ওপর স্থির থেকে যুগে যুগে অসংখ্য মানুষকে নির্মম নির্যাতন সইতে হয়েছে, ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছে এমনকি প্রাণও দিতে হয়েছে। কোরআন-হাদিসে এমন ঘটনার কথাও উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, তবুও তারা আল্লাহ যে একমাত্র রব, এ স্বীকৃতি থেকে এক চুল পরিমাণ সরেননি। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করার কারণে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছেন। সহ্য করেছেন শারীরিক অত্যাচারও।
মানুষ আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি। মহান আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যতবার বোঝানো হয়েছে, সব জায়গায় রব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ আল্লাহতায়ালার একত্ববাদের অন্যতম শাখা ‘মহান আল্লাহ সৃষ্টিজগতের অদ্বিতীয় প্রতিপালক’ এ কথার ওপর বিশ্বাস স্থাপন। আল্লামা ইবনে আবিল ইজ্জ (রহ.) বলেন, ‘রুবুবিয়্যাতের (প্রভুত্বের ওপর বিশ্বাস) ক্ষেত্রে একত্ববাদ হলো এটা বিশ্বাস ও স্বীকার করা যে আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা, প্রতিপালক ও জীবিকা দানকারী। তিনিই জীবন-মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক। সৃষ্টিজগতে কাজ ও গুণাবলিতে তার কোনো সমকক্ষ নেই।’ -শারহুত তাহাবিয়্যা : ১/২৫
কোরআন মাজিদে রব হিসেবে মহান আল্লাহর পরিচয় এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘মহান আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের জীবিকা দান করেছেন, তোমাদের মৃত্যু দেবেন এবং তোমাদের পুনরায় জীবিত করবেন।’ -সুরা আর রুম : ৪০
নৈতিক চরিত্র, সমাজ-রাজনীতিসহ জীবনের সব দিক ও বিভাগে সর্বোচ্চ এবং সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। তিনি পথপ্রদর্শক এবং আইনপ্রণেতা। একমাত্র তিনিই দিতে পারেন আদেশ ও নিষেধ, আনুগত্য একমাত্র তারই পাওনা। দুনিয়ার যেখানেই নবী-রাসুল এসেছেন, রব হিসেবে আল্লাহকে তারা মৌখিক ও বাস্তবে মানতেন এবং আল্লাহর রুবুবিয়্যাত প্রতিষ্ঠার জন্য আমরণ চেষ্টা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহতায়ালা আমাদের জন্য ইসলামকে একমাত্র দ্বীন ও পূর্ণরূপে ইসলামে দাখিল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহর সেই নির্দেশকে মানুষ নিজের সুবিধামতো ভাগ করে নিয়েছে। অথচ এই মানুষই সৃষ্টির আগে, সৃষ্টির পরে দিনে-রাতে আল্লাহকে একমাত্র রব হিসেবে ঘোষণা করছে।
আমাদের সমাজে এমন চরিত্রের লোক রয়েছে, যারা ইসলামকে দ্বীন ও দুনিয়া দু’টি ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। তারা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ, মিলাদ-ওয়াজ মাহফিল ইত্যাদি যেসব কাজে দ্বীনদারির রং রয়েছে তাতে মোটামুটি নিষ্ঠাবান। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, চাকরি, লেনদেন, আচার-আচরণ, আত্মীয়স্বজনসহ মানুষের হকের (পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান প্রসঙ্গে) বিষয়ে আদায়ে তত নিষ্ঠাবান নন।
অথচ মানবজীবনের ব্যাপ্তি যতখানি, ইসলাম ঠিক ততখানি। ইসলামের দাবি হলো- অংশবিশেষ নয়, সম্পূর্ণটা মানতে হবে। ইসলাম মানতে হবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে আচার-আচরণে, লেনদেনে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, চাষাবাদে, চাকরি-বাকরি, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ জীবনের সবক্ষেত্রে। এই মানার নামই হলো মহান আল্লাহকে রব হিসেবে ঘোষণার প্রকৃত দাবি। এ জন্যই আল্লাহতায়ালা আহ্বান জানিয়েছেন এই বলে, ‘হে ইমানদার লোকেরা! তোমরা পূর্ণরূপে ইসলামে দাখিল হও।’ বর্ণিত আয়াতে শুধু ইসলামে দাখিল হওয়ার কথা বলা হয়নি, অতিরিক্ত শব্দ ‘পরিপূর্ণ’ যোগ করা হয়েছে। স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এমন করা যাবে না, যে নির্দেশগুলোতে নিজেদের স্বার্থ রয়েছে, মনমতো হয়েছে সেগুলোর ওপর আমল করবে এবং অন্য নির্দেশগুলো ত্যাগ করবে। আর এমন পূর্ণ মুসলমানের জন্যই রয়েছে অসংখ্য নিয়ামতে ভরা বেহেশত।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.