আবদুল আজিজ:
‘সীমান্ত এলাকায় জন্ম, সীমান্তেই বেড়ে ওঠা। যুগ যুগ ধরে বাপ-দাদারা এখানে বসবাস করে আসছে। জীবনে মিয়ানমারের ওপারে অনেক কিছুই দেখেছি। কিন্তু কোনও দিন কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। এবারও কোথাও যাবো না। প্রশাসন পারলে নিরাপত্তা দিক, তা নাহলে সীমান্তেই জীবন-মরণ।’
কথাগুলো বলছিলেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব ফরিদ আলম। প্রায় দেড় মাস ধরে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলি চলছে। প্রতিদিন গোলাগুলি ও গোলা বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠছে সীমান্ত এলাকার বাড়িঘর। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছেন সেখানকার বাসিন্দারা। এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার তিন শতাধিক পরিবারকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে প্রশাসন। তবে ফরিদ আলমের মতো সীমান্ত এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা বলছেন, তারা বাড়িঘর ছাড়তে কোথাও যেত চান না। তারা নিরাপত্তা চান।
সীমান্তের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল গফুর বলেন, ‘মিয়ানমারের ওপারে প্রতিদিন গোলাগুলি চলছে। এতে আতঙ্কে দিন কাটছে আমাদের। এই পরিস্থিতিতে সরকার আমাদের সরিয়ে নিতে চাইছে। তবে আমরা সীমান্ত ছেড়ে কোথাও যাবো না। সীমান্তে আমাদের জীবন-মরণ। আমাদের কোথাও সরানো মানে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।’
একই কথা বললেন বাজারপাড়া এলাকার বাসিন্দা মৌলনা রফিক উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি একেবারে সীমান্তের কাছে। বাড়ির ঠিক ওপারে মিয়ানমার বাহিনীর ক্যাম্প। ওই ক্যাম্পে বসে আমার বাড়ির উঠানের সবকিছু দেখা যায়। আমাদের খুব ভয় হচ্ছে। কখন কী হয়ে যায় ঠিক নেই! সরকার যদি পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খল রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত করে আমাদের নিরাপত্তা দিলে নির্ভয়ে বাস করতে পারতাম।’
একই এলাকার মোহাম্মদ আবছার উদ্দিন বলেন, ‘মিয়ানমারে ওপারে গোলাগুলির কারণে আমাদের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। সীমান্তের কাঁটাতারের পাশের জমিতে রয়েছে ধানক্ষেত। আমরা বেশ কয়েকদিন ধরে ক্ষেতে যেতে পারছি না। গরু-ছাগলও বের করতে পারছি না। আবার এসব ফেলেও কোথাও যাওয়াও যাচ্ছে না। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।’
সীমান্তের তুমব্রু সীমান্তের কাঁটাতারের ১০ গজের মধ্যে মোহাম্মদ আরিফের বসতবাড়ি। তিনি বলেন, ‘সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে মিয়ানমারের বাহিনী মাটিতে মাইন পুঁতে রেখেছে। যেকোনও মুহূর্তে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ইতিমধ্যে সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে অনেকেই হতাহতও হয়েছেন।’
কোনারপাড়ার শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘মিয়ানমার ইচ্ছাকৃতভাবে শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের তাড়াতে চাই। মিয়ানমার চাই না আমরা শূন্যরেখায় থাকি। এ কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প লক্ষ্য করে মর্টারশেল নিক্ষেপ করছে। আমরা বিষয়টি চিঠি দিয়ে জাতিসংঘকে জানিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মিদের গোলাগুলিতে সীমান্ত এলাকা কেঁপে উঠছে। খবর পেয়েছি রাখাইনে কয়েকটি সীমান্ত ফাঁড়ি আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। তাই, দখল হয়ে যাওয়া সীমান্ত ফাঁড়ি উদ্ধার করতে হেলিকপ্টার ও জেট বিমানের মাধ্যমে গুলি ছোড়া হচ্ছে। এ কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অন্ধকারে রয়েছে।’
ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আতঙ্কে গতকাল সন্ধ্যায় বাইশফাঁড়ি হেডম্যানপাড়া এলাকার অনেকে হোঁয়াইক্ষ্যাং পশ্চিম হরিহোল এলাকায় আত্মীয়-স্বজনদের কাছে চলে গেছে। সকালে কয়েকটি ভারী অস্ত্রের ফায়ারের শব্দ শোনা গেছে। নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় বিজিবি ও পুলিশের নিরাপত্তা টহল জোরদারের কারণে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি।’
ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘যেহেতু সীমান্ত এলাকায় বসবাস, সেহেতু সমস্যা একটু হবে। এজন্য বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। সীমান্ত এলাকার মানুষেরা অদম্য সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবে। সরকারের সুন্দর চিন্তা-ভাবনায় আমাদের আস্থা রয়েছে।’
গত সোমবার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি ও পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম।
এ সময় জেলা প্রশাসক বলেন, ‘তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের কীভাবে নিরাপদে রাখা যায় সে ব্যাপারে পরিদর্শন শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারা যাতে আতঙ্কিত না হয়, সেজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পাশে থেকে উৎসাহ ও সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তবে এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়।’
পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তে কঠোর অবস্থানে আছে বিজিবি। এছাড়া পুলিশের কড়া নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
গত ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন ঘুমধুম এলাকার জনবসতিতে দুটি মর্টারশেল এসে পড়ে। এতে কেউ হতাহত না হলেও সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এরমধ্যে দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ করে দেশটি।
এসব ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তিনবার তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আবার এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে যাবে বলেও তখন হুঁশিয়ারি দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু গত শুক্রবার মর্টারশেল ও ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে হতাহতের পর উদ্বেগ বেড়ে যায়। এসব ঘটনায় এক মাসে চতুর্থবারের মতো গত রবিবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপরও গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আতঙ্ক বাড়ছে সীমান্তে।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.