মোস্তফা কামাল:
সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য ইত্যাদি বিশেষণের নির্বাচনের দাবির চেয়ে এখন ভোটের যন্ত্র, সিসি ক্যামেরার আলাপের বাজার বেশি গরম। গাইবান্ধার উপনির্বাচন বন্ধের পর ইভিএম নামের ভোট মেশিনকে পেছনে ফেলে সিসি ক্যামেরা আলোচনার সামনে চলে এসেছে। সঙ্গে আপত্তি-সমালোচনাও। সামনের নির্বাচনটি কোন সরকারের অধীনে হবেএ-বিষয়ক আলোচনাও আগের জায়গায় নেই। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক অবস্থা যে জায়গায় চলে গেছে সেখানে তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না অনেকেই। গাইবান্ধা উপনির্বাচনের ক্যারিকেচার ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ডিসি-এসপিদের স্পর্ধিত আচরণে হয়তো তারা এ উপলব্ধিতে এসেছেন।
পুরো সাংবিধানিক কাঠামোতে পরিবর্তন না আনা হলে হাতে, ইভিএমে, ক্যামেরা পেতে বা আরও কোনো মেশিন ব্যবহার করেও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা যেন দুরাশায় এসে ঠেকেছে। সিসি ক্যামেরা থাকাতেই ইসি অনিয়মের কারণে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন বাতিল করার উপাদান পেয়েছে এমন ভাবনাও খণ্ডিত। কারণ একটি আসনের উপনির্বাচনে সিসি ক্যামেরা দেখে অনিয়ম চিহ্নিত করা গেলেও তিনশ আসন সিসি ক্যামেরার আওতায় এনে এমন নজরদারি করা যাবে এ আশা করা যায় না। তার ওপর উপনির্বাচনে আটঘাট বেঁধে ইসির অনিয়ম উদঘাটন আর সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইসির সমালোচনাও মোটাদাগের কিছু সন্দেহকে পাকাপোক্ত করে দিয়েছে। এর মধ্যেই কেন্দ্রের গোপন কক্ষে সিসি ক্যামেরা বসানোকে শিষ্টাচার লঙ্ঘন বলছে সরকার। তাদের কাছে এটি প্রাইভেসির খেলাপ। কমিশনও এ যুক্তিতে সায় দিয়েছে। ইসি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে, গোপন কক্ষে নয়, ক্যামেরা বসানো হবে ভোটকক্ষে। কারণ গোপন কক্ষে ক্যামেরা পাতলে কে কাকে ভোট দেয় তাও ফাঁস হয়ে যাবে। যুক্তি আসলেই বড় কড়া। কমিশনার মো. আলমগীরের ভাষায় : কে কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন তা দ্বিতীয় ব্যক্তির জানা ঠিক নয়। তা জানার অধিকার নেই সিইসি বা কমিশনারদেরও।
এদিকে, যে যত কথাই বলুক ইভিএমের সাফাই থেকে সরছে না নির্বাচন কমিশন। তাদের কাছে ইভিএম সাবজেক্ট। আর ভোট অবজেক্ট। নতুন করে এই মেশিনটি কিনতে না পারলে যেগুলো আছে তা দিয়েই যতগুলো সিটে সম্ভব ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে কারচুপি ও অনিয়ম রোধে নির্বাচনে ইভিএমের চেয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনসহ কয়েক সাবেক নির্বাচন কমিশনার। আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধের সিদ্ধান্তের পক্ষে কড়া সমর্থন দেন সাবেক তিন সিইসি বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ, কাজী রকিব উদ্দিন এবং কে এম নুরুল হুদা ও তাদের সহকর্মী কমিশনাররা। ক্যামেরা আর ইভিএম দুটোই যন্ত্র। এই মেশিন স্বয়ংক্রিয় নয়, এসব মানুষ পরিচালনা করে। এই মানুষজন কী করেন, আরও কী করতে পারেন তা জানার আর বাকি আছে কি? যা হাতে করা যায়, তা যে মেশিনেও করা যায় সেই চিত্র দেখা গেছে বিভিন্ন জায়গায়। আবার সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গকে চেপে রেখে ইভিএম বা ক্যামেরার মতো যন্ত্রপাতি কেনায় কেন এত গরজ? এর মাজেজা বা মতলব বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। এর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিষয়-আসয়ও বোধগম্য। অথচ, মেশিনের চেয়ে জায়গামতো প্রকৃত মানুষের প্রয়োজনীয়তা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের যে কেউই উপলব্ধিতে সক্ষম।
অটো পাইলট বা অটোপাসের যুগেও মেশিনের পেছনে নিরপেক্ষ মানুষের বিকল্প নেই। আর সিসি ক্যামেরায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্টের যুক্তিকে অতিগুরুত্ব দিলে জামালপুরের সেই ডিসির মতো বিশিষ্টজনরা যারপরনাই খুশি হবেন। বার্নিং কোশ্চেনের মতো বলতে পারবেনখাসকামরায় কেন সিসিটিভি? এই গোত্রের বাইরে যে শেয়ান আর বিচক্ষণও অনেকে আছেন সেই বার্তাও রয়েছে। যারা সুযোগ পেলে উচিত কর্মটি সেরে ফেলেন। এর ছোট্ট একটি উদাহরণ টাঙ্গাইল জেলা পরিষদ নির্বাচনে বাসাইলের এক সদস্য প্রার্থীর বিতরণ করা টাকা ফেরত চাওয়া। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় টাকা ফেরত চেয়ে স্ট্যাটাস না দিয়ে একা একা নীরবে-নিভৃতে টাকা তোলার চেষ্টা চালালে খবরটি গোপনই থাকত। সেখানকার জেলা পরিষদ নির্বাচনে এক সদস্য প্রার্থী ভোটের জন্য গুনে-গুনে টাকা দিয়েছেন ৫৫ জনকে। কিন্তু, ভোট দিয়েছেন মাত্র সাতজন। অন্যদের নেওয়া টাকা ফেরত চেয়েছেন প্রার্থী রফিকুল ইসলাম। ফেইসবুকের স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা চারজন প্রার্থী ছিলাম। ভোটার ছিল ৯৪ জন। দিন শেষে জানা গেল, প্রত্যেক প্রার্থী ৫০ থেকে ৬০ জন ভোটারকে টাকা দিয়েছেন। তার মধ্যে আমাকে ৬০ জন ভোটার কথা দিলেও এর মধ্যে কম-বেশি ৫৫ জন ভোটার আমার কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করল। ভোট দিল মাত্র ৭ জনে। এই হলো ভোটারদের আসল চরিত্র। পৃথিবীর সবকিছুই একবার দেখলে চেনা যায়, শুধু মানুষ বাদে। আমাকে যারা ভোট দেননি মনে হয় আপনাদের নামের তালিকা হওয়ার আগে আমার টাকা ফেরত দেওয়া উচিত। আপনারা না জনপ্রতিনিধি! ভোট আপনি যাকে খুশি তাকে দেন, এটা আপনাদের অধিকার, তাই বলে টাকা নেবেন চারজনের কাছ থেকে, ভোট দেবেন একজনকে। এটা কেমন চরিত্র আপনাদের?’ কয়েকজন তাকে পরে টাকা ফেরতও দিয়েছেন। তাই তিনি ফেইসবুক স্ট্যাটাসটিও সরিয়ে নিয়েছেন। আবার পটুয়াখালীতে জেলা পরিষদ নির্বাচনে তো ২ হাজার করে টাকা নিয়েও ভোট না দেওয়ায় টাকা ফেরত চেয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন সদস্য প্রার্থী রুবিনা আক্তার। নির্বাচনে হারার পর তিনি টাকা ফেরত চাইতে রাতে ভোটারদের বাড়ি-বাড়ি যাওয়া শুরু করেন। কিছু টাকা ফেরত পেয়েছেন। আবার কয়েক জায়গায় লাঞ্ছিতও হয়েছেন। সিরাজগঞ্জের ঘটনা আরও ইন্টারেস্টিং। নতুন দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা সেখানে। ভোটের আগের রাতে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোটারদের হাতে টাকার বান্ডিল তুলে দেন নির্বাচনী মাঠের এক শেয়ান প্রার্থী সুমন সরকার। ঘটনা জানাজানি হয়ে যাবে এ শঙ্কা দেখিয়ে টাকাগুলো ভোটের আগে খরচ করতে সাবধান করে দেন। নির্বাচনে জিতেও যান তিনি। এরপর খরচ করতে গিয়ে ভোটাররা দেখেন ওই টাকাগুলো জাল। তারা ছুটে যান নেতা সুমন সরকারের কাছে। তিনি তাদের দেখান পুলিশে ধরা পড়ে জেল খাটার ভয়। সাফ জানিয়ে দেন জালনোট যার কাছে পাওয়া যাবে, তাকেই ধরবে পুলিশ। ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছে তার বুদ্ধিতে। টাকা নেওয়া ভোটাররা নিজে নিজেই রয়েছে দৌড়ের ওপর।
বাংলাদেশে গড়পড়তা নির্বাচনের মাঠচিত্র এমনই। প্রার্থী ও ভোটার পরস্পর পরিচিত। স্বভাব-গুণ-বৈশিষ্ট্য কাছাকাছি। কে কত ভালো তা জানেন প্রার্থী-ভোটার উভয়েই। যদিও বাংলাদেশে অনেকেই কেজরিওয়ালের মতো নেতা আশা করেন। কেজরিওয়াল দেবদূত নন। মাটি-মানুষের মধ্য থেকে রাজনৈতিক স্বচ্ছচর্চা ও জনসম্পৃক্ততার মধ্য দিয়েই তিনি বেড়ে উঠেছেন দিনে দিনে। হরিয়ানায় জন্মানো এই কেজরিওয়াল ছিলেন একজন প্রকৌশলী, আইসিএস অফিসার। চাকরির মোহ ছেড়ে তিনি কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতিতে নামলেও মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় আম আদমি পার্টি গঠন করেন। অল্প সময়ে অনেকের দৃষ্টিতে পড়েন। নানান কিছু করে ফেরার আওয়াজ দেননি। বিশেষ অঙ্গীকার করেন রাজস্ব আদায় এবং সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি দমনের। ভারতের মতো ধনবাদী দেশে পরিবারতন্ত্র, হিন্দুত্ববাদ ও জাততন্ত্রের মধ্যে তার অভ্যুদয়।
আমাদের ভোটাররা কি নিজেকে কেজরিওয়ালের মতো প্রার্থীর ভোটার হওয়ার উপযুক্ত হচ্ছেন? গণতন্ত্রহীনতায় দম নিতে নিতে ভিন্ন ধরনের বশ্যতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে অনেকে। শাসনে-প্রশাসনে জবাবদিহিহীনতা, সুশাসনে খরা, সীমাহীন দুর্নীতি কারও কারও জন্য কল্যাণের। বেশুমার অর্থ পাচার আশীর্বাদের। এরা ক্ষমতায়-হিম্মতে বলীয়ান। দেশের-সমাজের বহুজন ওই হিম্মতওয়ালাদের ক্যারিশমায় তুষ্ট। এমন অসাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের আদমিরা কিন্তু নিজেদের দাবি করেন সাধারণ নাগরিক। খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, সাধারণ এই আদমিরা মাঠে-ঘাটে, টকশোতে পর্যন্ত বলেই বসছেন, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন উত্তম। ভোটের চেয়ে টাকা জরুরি। এ ধরনের চারিত্রিক উপসর্গধারীদের নিয়ে-দিয়েই কাজ করবে নির্বাচন কমিশন। এখানে মৃতদের ভোটকেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা আছে। মৃতদের মৃত্যুর ৯/১০ বছর পর ব্যাংক লোন পাইয়ে দেওয়ার সুযোগও আছে। হাত আছে বলে তারা হস্তক্ষেপ জানে। পা থাকায় পদক্ষেপ নেয়। এর বিপরীতে নানা ঘটনা-রটনা, দুর্ঘটনার মধ্যেও প্রতিবেশী দেশটিতে এখনো কেজরিওয়ালদের জন্মানো এবং বেড়ে ওঠার পরিবেশ আছে। সেই মানের ভোটারও আছেন।
অনেক বাস্তবতা বিবেচনা করেই আমাদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে হবে। তারপরই না ভোট, ইভিএম, সিসি ক্যামেরা ইত্যাদি। এসব মেশিন চালাতে মানুষ লাগে। ইভিএমে ভোট দেওয়া-নেওয়ার পর আছে যোগ-বিয়োগ তথা ঘোষণা পর্ব। আর সিসি ক্যামেরা দেখার বিষয়। বাড়ির চারদিকে সিসি-ক্যামেরা লাগিয়ে গৃহকর্তা জেগে নাক ডেকে ঘুমালে বা না দেখলে কী হবে? কারও কি কিছু করার থাকবে? আবার করতে চাইলে করা যায়। যার দৃষ্টান্ত গাইবান্ধা। সদ্য শেষ হওয়া জেলা পরিষদ নির্বাচনও আরেক উদাহরণ। বাকিটা যার যার বুঝ।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.