মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
ইসলামি শরিয়তে সত্য নির্ণয়ের মাপকাঠি হলো পবিত্র কোরআন ও হাদিস। সেই সঙ্গে কোরআন-হাদিস যেসব বিষয়কে শরিয়তের দলিল ও হক নির্ণয়ের মাপকাঠি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সেগুলো। সুতরাং যেখানে হক-বাতিল (সত্য-মিথ্যা) নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেবে, সেখানে হক নিরূপণের জন্য শরিয়তের এই মানদ- ব্যবহার করতে হবে। এর বাইরে ভিন্ন কিছু ভাবার কিংবা করার সুযোগ নেই। অনেকেই বলেন, আমি বড়দের অনুসরণ করি, অমুক দলের সমর্থক। তারা যা বলেন এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমি যেতে পারি না, যাব না। এমন চিন্তা ও মনোভাব ইসলাম সমর্থন করে না। এটাকে শরিয়তের পরিভাষায় আসাবিয়্যাত বলে।
ইসলাম আসাবিয়্যাত অপছন্দ করে। আসাবিয়্যাত অর্থ গোত্রপ্রীতি, সাম্প্রদায়িকতা, স্বজনপ্রীতি ও স্বদলপ্রীতি প্রভৃতি। এক সাহাবি হজরত রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আসাবিয়্যাত’ কী? জবাবে তিনি ইরশাদ করলেন, অন্যায় কাজে স্বগোত্র-স্বজাতির পক্ষে দাঁড়ানো (সুনানে আবু দাউদ : ৫০৭৮)। অর্থাৎ অন্যায়, জুলুম ও ভুল কাজ-কর্মে কাউকে শুধু এ জন্য সমর্থন করা যে, সে তার নিজ দল, গোত্র, জাতি, দল ও ধর্মের লোক এটাই আসাবিয়্যাত; এটাই সাম্প্রদায়িকতা। আপনি কোরআন মাজিদের সুরা আন নিসা’র শুরু থেকে পড়ুন, দেখবেন ইসলাম মানবতার বন্ধনকে কীভাবে দৃঢ় করেছে। আল্লাহতায়ালা কীভাবে সব মানুষকে একই পিতা-মাতার সন্তান ঘোষণা দিয়ে তাদের পরস্পরের আপন বানিয়েছেন। হজরত হুজাইফা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘সব জাতি যেন তাদের বাপ-দাদা তথা বংশ নিয়ে গর্ববোধ থেকে ফিরে আসে অন্যথায় তারা আল্লাহর কাছে নাপাকির পোকামাকড় থেকেও নিকৃষ্ট গণ্য হবে’ (মুসনাদে বাযযার : ২৯৩৮)।
সুনানে আবু দাউদের অন্য বর্ণনায় আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে আসাবিয়্যাত (সাম্প্রদায়িকতা)-এর দিকে আহ্বান করবে (অন্যায় কাজে নিজ দল, গোত্র, জাতিকে সাহায্য করতে বলবে) সে আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয়। যে এমন সাম্প্রদায়িকতার কারণে মৃত্যুবরণ করবে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়’ (সুনানে আবু দাউদ : ৫০৮০)। এ বিষয়ে বর্ণিত আরও একাধিক সহিহ হাদিসের মর্ম হলোযে ব্যক্তি জাতীয়তা কিংবা ভাষার ভিত্তিতে অন্যায় হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর সহযোগিতা করে এবং দল, গোত্র, বংশের ভিত্তিতে অন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে মারা যায় সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল। যে উম্মতের বিরুদ্ধে অস্ত্র উঠিয়ে ভালোমন্দ সবাইকে হত্যা করতে থাকে সে মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত নয়।
বিদায় হজের বিখ্যাত ভাষণের কথা সবারই জানা। যেখানে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘ভাষা, বর্ণ ও গোত্রের ভিত্তিতে কারও ওপর কারও প্রাধান্য নেই।’ তিনি বলেছেন, ‘কোনো আরব অনারবের ওপর (শুধু ভাষার কারণে) প্রাধান্য পাবে না। কোনো সাদা (তার বর্ণের কারণে) কালোর ওপর প্রাধান্য দাবি করতে পারবে না। প্রাধান্যের একমাত্র ভিত্তি হবে তাকওয়া (আল্লাহভীতি)’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩৪৮৭)।
মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরি (রহ.) বলেন, ‘বড়দের কাজ তখনই দলিল হবে, যখন তা কোরআন-হাদিস এবং স্বর্ণালি তিন যুগের আমল দ্বারা সমর্থিত হবে। সর্বাবস্থায় বড়দের কাজ গ্রহণ করাটা তাদের অনুসরণ নয়; বরং এটাকে আকাবিরপূজা (বড়দের) বলে।’ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) দ্বীন বিকৃতির সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তার একটি ‘ইসতিহসানে মাশায়েখ অর্থাৎ বড়রা যে কাজ পছন্দ করেন, পরবর্তী প্রজন্ম সেটাকেই দ্বীন মনে করে বসে। এর মাধ্যমে দ্বীন-ধর্মের বিকৃতি হয়।’ হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন দ্বীনের ক্ষেত্রে কারও অন্ধ অনুসরণ না করে। যদি সে ইমান আনে তাহলে এ ব্যক্তিও ইমান আনে। আবার সে যদি কাফের হয়ে যায়; তাহলে এ ব্যক্তিও কাফের হয়ে যায়। কেননা মন্দের ভেতরে কোনোরূপ আদর্শ নেই’ (ইলামুল মুআকিয়িন: ২/১৭৬)।
শাইখুল ইসলাম ইবনুল কাইয়্যিম আল জাওযিয়্যাহ (রহ.) বলেন, ‘দুই ধরনের কাপড় পরিধান করা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নাও। যে এই দুই কাপড় পরিধান করে, সে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। সেই বস্ত্রদ্বয়ের একটি হলো চরম মূর্খতা ও অজ্ঞতা, দ্বিতীয়টি অন্ধভাবে স্বীয় পক্ষে কঠোর হওয়া, কতই না নিকৃষ্ট এ বস্ত্রদ্বয়!’
বিষয়টি শঙ্কার কারণ হলেও অনেকে এটাকে এখনো অবহেলার দৃষ্টিতে দেখছেন। অনেকেই আবার হেকমতের দোহাই দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, সমস্যা যখন ছোট থাকে; তখন বিষয়টিতে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু যখন তা বিশালাকার ধারণ করে, প্রবল বন্যার মতো সব কিছু ভাসিয়ে নিতে থাকে, তখন হুঁশ ফেরে। ততদিনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরপর অপরিকল্পিতভাবে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা ওই স্রোতকে থামাতে তো পারেই না; উল্টো আরও বেগবান করে।
ইসলামি বিধানে এটা স্পষ্ট, আসাবিয়্যাত তথা স্বদল, স্বজাতি ও স্বগোত্রপ্রীতি এক ভয়ংকর ফিতনা। জাহেলি যুগে আরবদের দশা ছিল এমন। সর্বত্র বিরাজ করত গোত্রীয় পক্ষপাতিত্ব ও দম্ভ অহংকার। তাদের নীতি ছিল, আমি আমার ভাইকে সাহায্য করব, সে অত্যাচারিত হোক বা অত্যাচারী। বর্তমান সমাজেও এই মনোভাব বিস্তৃতি লাভ করেছে। ফলে আপন লোকদের দোষত্রুটি দেখেও অনেকেই অন্ধ। অন্যদিকে কোনো দুর্বল ব্যক্তির সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলেই দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া হয়। অত্যাচারিতের প্রতি আরও বেশি করে অত্যাচার আজ যেন ‘স্মার্টনেস’ হয়ে উঠেছে। অথচ ইসলাম শিক্ষা দেয়, অত্যাচারিতকে সাহায্য করতে আর অত্যাচারীকে প্রতিহত করতে, সে আমাদের আত্মীয়ই হোক বা অনাত্মীয়।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি লোকদের গোত্রবাদের দিকে আহ্বান করে অথবা গোত্রবাদে উন্মত্ত হয়ে ভ্রষ্টতার পতাকাতলে যুদ্ধ করে নিহত হয়, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’ (ইবনে মাজাহ : ৩৯৪৮)।
নিবন্ধে যে কয়টি উদাহরণ পেশ করা হলো তার সবই ইসলামের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা এবং কঠোর নিন্দনীয় এবং ইহ ও পরকালীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ বর্তমান সময়ের প্রচারমাধ্যমগুলো এগুলোকে সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে দেখতে চায় না। সমাজের লোকজনও তা মনে করে না। এমন মনোভাবের পরিবর্তন কাম্য।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.