মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রীদের জন্য সাশ্রয়ী খরচে ২০২৪ সাল থেকে ৩২ তলাবিশিষ্ট জাহাজ চলাচল শুরু হবে চট্টগ্রাম-জেদ্দা নৌরুটে। দেশের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী শিপবিল্ডার্স লিমিটেড এই রুট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, জাহাজটির পরিচালনায় একটি নীতিমালা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রণয়ন করা হচ্ছে। কোম্পানি জাহাজটি আনার অনুমোদন পেলে, এটি আট দিনে চট্টগ্রাম থেকে সৌদি আরব যাত্রী নিয়ে যাবে। আগে সমুদ্রপথে সৌদি আরব যেতে এক মাসের মতো লাগলেও, এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ জাহাজগুলো উচ্চগতিতে চলাচল করতে পারে। এর মাধ্যমে হজযাত্রীদের খরচ কমবে। জাহাজে একসঙ্গে ৩ হাজার যাত্রী বহন করা যাবে। বর্তমানে হজে উড়োজাহাজ ভাড়াসহ অন্যান্য খরচে জনপ্রতি ৫ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়। সমুদ্রপথে জাহাজে হজযাত্রীদের কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা কম খরচ হবে বলে জানিয়েছে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে বিদেশি হজযাত্রীদের জন্য ২ বছর পবিত্র হজপালন বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে নানা শর্তারোপ করে বিদেশিদের হজপালনের অনুমতি দেয় সৌদি আরব। চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৬০,১৪৬ জন হজপালনের জন্য সৌদি আরব গমন করেন। এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজপালনে প্যাকেজ-১ এ ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪০ এবং প্যাকেজ-২ এ ৫ লাখ ২১ হাজার ১৫০ টাকা ঘোষণা করা হয়। এর সঙ্গে সংগতি রেখে বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলোর সর্বনিম্ন প্যাকেজ ঘোষণা করে ৫ লাখ ২২ হাজার ৭৪৪ টাকা। হজ শেষে ১০ হাজার থেকে ৪৭ হাজার টাকা পর্যন্ত ফেরত পান সরকারি ব্যবস্থাপনার ৩ হাজার ৭০০ জন হজযাত্রী। সৌদি আরবে বাড়ি ও হোটেল ভাড়ার জন্য ব্যয় না হওয়া অর্থ তাদের ফেরত দেওয়া হয়। বেসরকারি হজ এজেন্সি কোনো টাকা ফেরত দেয়নি।
হজ একটি ফরজ ইবাদত। প্রতি বছর বিশ্বের লাখ লাখ সামর্থ্যবান মুসলমান হজপালনের জন্য মক্কা মোকাররমায় সমবেত হন। বাংলাদেশ থেকেও লক্ষাধিক মুসলমান হজপালন করেন। হজপালনের জন্য বাংলাদেশিদের একমাত্র বাহন হচ্ছে- উড়োজাহাজ। যদিও একটা সময় এ ভূখণ্ডের মুসলমানরা স্থলপথে এবং সমুদ্রপথে হজে যেতে পারতেন। স্থল ও সমুদ্রপথে হজে যাওয়ার খরচ ছিল অনেক সাশ্রয়ী। স্থল ও সমুদ্রপথে খরচ কম হওয়ায় তখন অনেক মুসলমান হজে যেতে পারতেন। সত্তরের দশকে সমুদ্রপথে হজে যাওয়ার সহজ সুযোগটি বন্ধ হয়ে যায়। আর পঞ্চাশের দশকে বন্ধ হয়ে যায় স্থলপথে হজে যাওয়ার সুযোগ। বর্তমান সরকার ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সমুদ্রপথে হজে যাওয়ার সুযোগটি চালুর চিন্তা-ভাবনা করে। বলা হয়, আগ্রহী ১৮ হাজার হজযাত্রী নৌপথে হজে যেতে পারবেন। কিন্তু অজানা কারণে সেই সাশ্রয়ী খরচের সহজ পথটি শেষ পর্যন্ত আর চালু হয়নি। আলোচনাও বেশিদূর এগোয়নি। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে স্থল, জল ও আকাশ এ তিনপথেই বাংলাদেশিদের হজে যাওয়া সম্ভব। স্থল ও জলপথে হজে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। স্থলপথে ট্রেনে করে ভারত, পাকিস্তান ও ইরান হয়ে সৌদি আরবের মক্কায় পৌঁছা সম্ভব। আর জলপথে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে আরব সাগর হয়ে জেদ্দা সমুদ্রবন্দর দিয়ে মক্কা মোকাররমায় পৌঁছা সহজতর। তবে এ জন্য সর্বাগ্রে দরকার বাংলাদেশ সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও কূটনৈতিক উদ্যোগ। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশ থেকে হজপালনে যাওয়া সেটা সরকারি অথবা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হোক না কেন, কমবেশি বিড়ম্বনা আছে। যত দিন যাচ্ছে, বিড়ম্বনা বাড়ছে বৈ কমছে না। এর পেছনে রয়েছে সীমাহীন অর্থলোভ। এক্ষেত্রে দেশীয় বেসরকারি হজ এজেন্সি, সরকারি কর্তৃপক্ষ, সৌদি সরকার ও তাদের নিয়োগকৃত মুয়াল্লিমরা একই কাতারের। কোনো পক্ষই মুনাফায় ছাড় দিতে চায় না। হজযাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা ও সেবার বিষয়ে তাদের নজর নেই, নজর শুধু মুনাফায়।
এমতাবস্থায় হজের খরচ কমিয়ে আনার জন্য সরকারের উচিত, উড়োজাহাজযোগে পাঠানোর পরিবর্তে সমুদ্রপথে হজযাত্রী পাঠানোর ব্যবস্থা করা। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি প্রচুর অর্থের সংস্থান হবে এবং হজের স্পিরিট হাজিরা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারবেন। এর মাধ্যমে সরকারও নানাভাবে উপকৃত হতে পারবে। হজযাত্রী বহন শেষে জেদ্দা থেকে ফিরতি পথে জাহাজগুলো প্রয়োজনানুযায়ী পণ্যসামগ্রী দেশে আনতে পারবে বিভিন্ন বন্দর থেকে।
সুদানের ১৮ হাজার হজযাত্রী ২০১৮ সাল থেকে সমুদ্রপথে হজপালনের সুযোগ পাচ্ছেন। ২০১৮ সালে ভারত সরকার এই ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। শিপিং করপোরেশন অফ ইন্ডিয়া হজযাত্রীদের নৌপথে হজযাত্রার ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে। সংস্থাটির আশা, ২০২৩ সালে থেকে তারা অল্পখরচে হজযাত্রী পাঠাতে পারবে। ১৯৯৫ সালে মুম্বাই থেকে সর্বশেষ হজযাত্রী বহন করে জাহাজ এমভি আকবরি। এরপর ভারতে থেকে সমুদ্রপথে হজযাত্রার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালে পাকিস্তান সরকারও সমুদ্রপথে হজ এবং ওমরাহর যাত্রীদের জেদ্দায় পাঠানোর কথা ঘোষণা করে। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়। ১৯৯৪ সালে করাচি বন্দর থেকে হজযাত্রীদের নিয়ে এমভি শামস শেষবারের মতো যাত্রা করে। পাকিস্তান থেকে ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো সমুদ্রপথে হজযাত্রী বহন শুরু হয়। যেহেতু প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং পাকিস্তান সমুদ্রপথে হজযাত্রী পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছে সেহেতু কূটনৈতিক চ্যানেলে বাংলাদেশ সরকার তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমুদ্রপথে হজযাত্রী পাঠানোর উদ্যোগ নিতে পারে। স্থল ও জলপথে হজগমনে শারীরিক সক্ষমতার বিষয়টি জড়িত। কিন্তু এ দুই পথে আর্থিক খরচ অনেক কমবে। প্রতি বছর হজের খরচ বাড়ার দরুন, হজপালন ক্রমেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে অনেকেরই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হজপালন করতে পারছেন না। অধরা থেকে যাচ্ছে পবিত্র হজপালনের স্বপ্ন।
আগেই বলা হয়েছে, পবিত্র হজপালনের উচ্চ ব্যয় মধ্যমশ্রেণি বা নিম্ন-মধ্যমশ্রেণির মুসলমানদের পক্ষে বহন করা অসম্ভব। তাই এ দুই শ্রেণির পক্ষে পবিত্র হজব্রত পালন তথা কাবা শরিফ তাওয়াফ, মদিনার মসজিদে নববিতে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, নবীজির রওজা জিয়ারত, জান্নাতুল বাকি জিয়ারত, নবীজির রওজা জিয়ারত, স্মরণীয় বিভিন্ন পবিত্র স্থান ও স্থাপনা দর্শনের আকাক্সক্ষা স্বপ্নই থেকে যায়। এই স্বপ্ন অপূরণীয় রেখেই এই দেশের অসচ্ছল মুসলমানদের কামলিওয়ালার দেশে গমনের আকাক্সক্ষা বুকে লুক্কায়িত রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সময়ের প্রেক্ষাপটে কয়েক বছর ধরে হজপালন সহজ করতে স্থল ও জলপথে হজে গমনের পথ উন্মুক্তের বিষয়টি আলোচনায় আসছে। সরকার যদি আন্তরিকতার সঙ্গে কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি সার্বিক বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় এবং জল, স্থল ও আকাশ এ তিন পথে হজে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে তাহলে বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানের পক্ষে হজপালন করা সম্ভব হবে। স্থল ও জলপথে হজপালনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে সরকারের পক্ষে জনসমর্থনও মিলবে। আশা করি, স্বল্পখরচে জাহাজে পবিত্র হজব্রত পালনের সুযোগ সৃষ্টি করে নিম্ন মধ্যবিত্ত মুসলমানদের মনের আকাক্সক্ষা পূরণে সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক ও নীতিগত সহায়তা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কারণ, হজপালনের বিষয়টির সঙ্গে মুসলমানের ইমান ও আবেগের একটি সম্পর্ক রয়েছে। সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এ প্রত্যাশা সবার।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক/muftianaet@gmail.com
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.