চিররঞ্জন সরকার:
রাজধানী ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র রাজনীতিতে যে ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল, সেই অবস্থা থেকে আপাতত রেহাই পাওয়া গেছে। বড় কোনো ধরনের সংঘাত-সহিংসতা ছাড়াই মহাসমাবেশ শেষ হয়েছে।
কিন্তু এই সমাবেশকে ঘিরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বৈরিতা ও দূরত্ব আরও বেড়েছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য মোটেও সুখবর নয়। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের দেশে একটা রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে ন্যূনতম সৌহার্দ্য-সদ্ভাব নেই। একে অপরকে জব্দ করার মিশন নিয়ে তারা পথ চলছেন। উভয় দলের কাছে ক্ষমতাই মুখ্য। ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতায় থাকার বাইরে তাদের আর কোনো ভাবনা নেই। যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা আর কী কী করবেন, এমন কোনো রূপরেখা যেমন নেই, যারা ক্ষমতায় যেতে চান, ক্ষমতায় গেলে তারা কী করবেন তারও কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই।
ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় যেতে পারলে সেটি যে কোনো ভাবে আগলে রাখাÑ এই বৃত্তের বাইরে দেশের রাজনীতির আপাতত কোনো গন্তব্য নেই। অথচ দেশের সার্বিক আর্থিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটু একটু করে খারাপ হচ্ছে। সুশাসনের অভাবে প্রশাসন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। কোথাও কোনো সুখবর নেই।
বক্তৃতা-বিবৃতি, বেফাঁস মন্তব্য আর নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ির মধ্যেই আটকে আছে দেশের রাজনীতি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থিক উন্নতি, সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো নীরব ভূমিকা পালন করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা গেলেও তা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল কোনো ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেনি। বিএনপির রাজনীতি খালেদা জিয়ার মুক্তি আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আর হুমকির মধ্যেই আটকে আছে। ফলে পরিবর্তনের কোনো দিশা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমাদের দেশের রাজনীতির কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। যেগুলো অন্য দেশ বা অন্য কোনো সমাজের সঙ্গে খুব একটা মিলবে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায়ও এসব পড়ে না। কিন্তু টিকে আছে বেশ দাপটের সঙ্গেই। এর মূল বিষয়গুলো মোটামুটি এই রকম : প্রথমত, দলের চেয়ে নেতা/নেত্রী বড়, অতএব নেতা/নেত্রীর নামে অবিরাম জয়ধ্বনি দেওয়াটাই দলের নেতা ও কর্মীদের একমাত্র কাজ। দ্বিতীয়ত, সাবেক রাজতন্ত্র উঠে গেলেও, রাজনৈতিক দলগুলো চলবে সেই নিয়ম মেনেই। রাজার ছেলে যেমন রাজা হতো তেমনই নেতা/নেত্রীর ছেলে বা মেয়েই (অবস্থা বুঝে ভ্রাতুষ্পুত্র-ভাই-ভাগ্নে এমনকি নাতিপুতিও চলতে পারে) পাবে উত্তরাধিকার সূত্রে দলীয় নেতৃত্বের ভার। দলের অন্য কোনো নেতার যোগ্যতা অথবা নেতৃত্বগুণ ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হবে না। সংক্ষেপে বলতে গেলে পারিবারিক শাসনই হবে দলের অস্তিত্বের প্রাণভোমরা। তৃতীয়ত, যেনতেন কায়দায় ক্ষমতা দখল এবং একবার ক্ষমতায় বসলে একই রকম যেনতেনভাবে তা রক্ষা করাই হবে দলের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই অভীষ্ট সাধনে যারাই বাধা সৃষ্টি করবে বা প্রশ্ন তুলবে হয় তাদের নানাবিধ লোভ দেখিয়ে বশে আনতে হবে নয়তো-বা প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে। আর এ কাজ করতে হবে দেশমাতৃকার নামে, বলতে হবে বিরোধিতা করছে যারা কিংবা প্রশ্ন তুলছে যারা, তারা সবাই দেশদ্রোহী, ষড়যন্ত্রকারী। আবার বিরোধী পক্ষের একমাত্র কাজ হবে সরকারের যাবতীয় উদ্যোগের বিরোধিতা করা, বিদ্বেষ ছড়ানো, উসকানি দেওয়া, যে কোনো উপায়ে গণ্ডগোল পাকানো এবং তা জিইয়ে রাখা। ক্ষমতাসীনদের জব্দ করতে, তাদের ওপর কলঙ্ক দিতে সম্ভাব্য সব কিছুই করা হবে। একবার চারদিকে চোখ মেলে তাকান, দেখবেন এই ‘নবরাষ্ট্রবিজ্ঞানই’ হয়ে উঠেছে আমাদের রাজনীতির মূলস্তম্ভ। আমাদের দেশের সব দলই মোটামুটি এই আদর্শের অনুসারী।
জাতীয় স্তরে আওয়ামী লীগের দিকে তাকান, দেখবেন সেই একই দৃশ্য। এখানে পারিবারিক শাসন এখনো চালু হয়নি ঠিক কিন্তু দলটি ধীরে ধীরে সভানেত্রী-সর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সভানেত্রীই যাবতীয় ক্ষমতার উৎস, তিনিই দলের একমাত্র পরিত্রাতা। তাকে সবাই ভক্তি করেন যতটা, তার চেয়ে ভয় করেন অনেক বেশি। তিনিই দলের একমাত্র মুখ, তিনিই একমাত্র ভোট-ক্যাচার। রাখলে তিনিই রাখবেন, মারলেও তিনিই। বিএনপিতেও একই দশা। পুরোই একটি পারিবারিক দল। জাতীয় পার্টিরও একই চিত্র। দেশে যে কয়টি প্রতিষ্ঠিত দল আছে তার প্রত্যেকটি আজ নেতা বা নেত্রীসর্বস্ব, কোনো দলেই অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের আর ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতৃত্বও অনেক ক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবারসর্বস্ব। বাপ মরলে বউ কিংবা সন্তান। এর কোনো বিকল্পই গড়ে উঠছে না।
রাজনীতিতে উন্নয়ন ও ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবার একটা প্রবণতাও এদেশে জোরেশোরেই গড়ে উঠেছে। কিছুদিন পর পরই ধর্মীয় রাজনীতিকে উসকে দেওয়া, নিজ স্বার্থে ব্যবহার করাÑ সবই চলছে অব্যাহতভাবে। প্রবলভাবে জাগিয়ে তোলা হয়েছে ধর্মানুভূতি। এই অনুভূতিতে কখনো আঘাত করে নাস্তিক নামধারী কেউ, কখনো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কেউ। তারপর চলে তাণ্ডব। এই তাণ্ডব থেকে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু ফায়দা আর সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিছু নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙে, সর্বস্বান্ত হয়। মার খায়। প্রতিমা ভাঙা হয়। তারপর সব ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আক্রান্ত পরিবার ও মানুষটা শুধু মনে মনে মরে যায়।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে অনেক কথা হয়, বিদ্বেষ, ঘৃণা, পারস্পরিক খেয়োখেয়ি অনেক হয়, কিন্তু পারস্পরিক কথোপকথন একেবারেই হয় না। অথচ কথোপকথনের রাজনীতির জানালাটা খোলা রাখাটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনীতিচর্চার একটি বৌদ্ধিক এবং মানসিক দিক আছে, আর অন্য দিকে রয়েছে রাজনীতির কায়িক চেহারা, যেখানে ‘দাপুটে’ নেতার রমরমা। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে রাজনীতির তথাকথিত ভদ্রলোকেরা শুধু নিজেদের সামাজিক পরিসরে ক্ষমতা দখলের খেলায় মেতে ওঠেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির বাইরে যে আখড়া, সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে। রাজনীতিচর্চা হয়ে দাঁড়ায় মুদ্রাদোষের মতো। না করে থাকতে পারেন না।
কেউ বলতে পারেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতি মানেও তো দুর্নীতি। তার জন্যই তো যত সমস্যা। কিন্তু এখানে সেটা প্রশ্ন নয়। পাড়ার স্কুল, কলেজ, ক্লাব, ট্রেড ইউনিয়নকে কব্জা না করে বা নিজেরই সহকর্মীকে বিভাগ থেকে না তাড়িয়ে, সেই কূটবুদ্ধি যদি তারা বৃহত্তর রাজনীতির মঞ্চে নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োগ করতেন, ভালো হতো না কি?
ক্ষুদ্র পরিসরে পরোক্ষ রাজনীতির কোনো সুফল নেই, এমন কথাও বলছি না। হাজার হোক, রাজনীতির সাহায্যেই তো অশুভ শক্তিকে ঠেকানো যায়, অন্তত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সেটাই শিক্ষা। কিন্তু অত্যধিক রাজনীতির সমস্যা বিস্তর। যেমন, নামি-দামি অধ্যাপকের পরিচয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম হওয়া উচিত। সেই নাম ও দাম তার কাজের প্রতিফলনে হবে, এটাই বাঞ্ছনীয়; কে ভিসি-প্রোক্টর হবেন, কে সিনেট-সিন্ডিকেটের সদস্য হবেন, তা নিয়ে নয়। এই কথাটাই আমরা এখন ভুলতে বসেছি।
পরিশেষে একটা সর্বগ্রাসী সর্বব্যাপ্ত রাজনীতির কথা না বলে পারছি না। ‘আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি’র রাজনীতি যেখানে কয়েকজন বলে, আর সবাই চুপ করে থাকে। অশান্তি নেই, প্রতিবাদ নেই, মিছিল নেই, মশাল নেই। যেন স্বেচ্ছায় স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছে সবাই কোনো এক অমোঘ, নিরঙ্কুশ, সদাসত্য রাজনৈতিক দর্শনের তাড়নায়। বিতর্ক নেই, তাই সংঘাতও নেই। দিনের পর দিন হাড়-হিম-করা শৃঙ্খলে আবদ্ধ সে ব্যবস্থা, যেখানে কাতারে কাতারে যোগ্য পদপ্রার্থীরা বঞ্চিত বা বিতাড়িত। শান্ত রাজনীতিই সর্বদা কাম্য, এমনটা হয়তো নয়।
রাজনীতি অবশ্যই চাই। সে রাজনীতি হবে কাজের ভিত্তিতে, সুস্থ প্রতিযোগিতা ও গণতান্ত্রিক বিধান মেনে। তর্ক চাই, প্রতিবাদ চাই, বিরোধিতাও চাই, কিন্তু সেটা হবে শালীন, নিয়মতান্ত্রিক, সুস্থ চর্চা। ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে গায়ের জোরে, কূটকৌশল প্রয়োগ করে সবকিছু দখল করে নেওয়া, নীতিহীন ষড়যন্ত্রের পথকে আদর্শ মেনে সেই ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর চর্চা চালিয়ে যাওয়া আর যাই হোক রাজনীতি হতে পারে না। এই রাজনীতি কেউ চায়ও না।
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
chiros234@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.