রায়হান আহমেদ তপাদার:
প্রযুক্তির ছোঁয়া এখন আর শুধু উন্নত দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই। তুলনামূলকভাবে কম উন্নত দেশগুলোতেও উন্নয়নের মাত্রায় যোগ করেছে ভিন্নতা। প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জীবনকে সহজ করে দেয় ঠিকই, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রযুক্তির ব্যবহারে দিন দিন কমে যাচ্ছে কর্মসংস্থান।
বইয়ের কথাই ধরা যাক। বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু দিন দিন বই পড়ার জন্য আমাজন কিন্ডল, ট্যাবলেট বা ইলেক্ট্রনিক বুক রিডার চাহিদা বেড়েই চলেছে। গড়ে উঠছে গুগল বুকস-এর মতো অনলাইন লাইব্রেরি। এসব লাইব্রেরিতে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা যে কোনো বই পড়া যায় ইচ্ছামতো। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ইন্টারনেট-ভিত্তিক লাইব্রেরি গড়ে তোলার কাজ শুরু করে দিয়েছে। বড় বড় প্রকাশনীও তাদের মুদ্রিত বইগুলোকে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরের কাজ শুরু করে দিয়েছে। ফলে প্রথাগত প্রকাশনা ও লাইব্রেরিগুলো খুব দ্রুত আবেদন হারাচ্ছে। এটা অনুমেয় যে, লাইব্রেরিয়ানের কাজটি একসময় নিতান্তই বিরল হয়ে যাবে।
যেকোনো খেলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য দায়িত্বে একজন নিয়োজিত থাকেন। যেমন, ফুটবলে রেফারি আর ক্রিকেটে আম্পায়ার। বর্তমানে ভিডিও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ফুটবলে ও ক্রিকেটে অনেক সিদ্ধান্তই রিভিউ করা হয় প্রযুক্তির মাধ্যমে। তাই সে সময় আর খুব বেশি দেরি নেই, যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক খেলার সব সিদ্ধান্তই প্রযুক্তির সাহায্যে নেওয়া হবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ফিউচার অব জব সার্ভে ২০২০ অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে আট কোটি চাকরি গায়েব হয়ে যাবে। তবে, নতুনভাবে উদ্ভব হবে আরও সাড়ে নয় কোটি চাকরির। যেসব চাকরির চাহিদা বাড়বে, তার প্রথম দিকে রয়েছে ডেটা বিশ্লেষক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ, বিগ ডেটা বিশেষজ্ঞ, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং কৌশল বিশেষজ্ঞ, প্রসেস অটোমেশন বিশেষজ্ঞ। আর যে চাকরির চাহিদা কমবে, সে তালিকার প্রথম পাঁচটি হলো ডেটা এন্ট্রি ক্লার্ক, প্রশাসনিক ও নির্বাহী সচিব, অ্যাকাউন্টিং, বুককিপিং এবং পে’রোল ক্লার্ক, হিসাবরক্ষক এবং নিরীক্ষক, উৎপাদন কারখানার শ্রমিক।
১৭৬০ সালের দিকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় প্রথম শিল্পবিপ্লব। বস্ত্র, খনিজ, কৃষি বিভিন্ন খাতে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয় শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। ১৮৭১ সাল থেকে শুরু হয় প্রযুক্তিগত দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। রেলপথ, টেলিফোন ও বিদ্যুতের আবিষ্কার সে বিপ্লবের সময় কারখানাগুলোকে দেয় নতুন গতি, অর্থনীতিকে দেয় অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি। এরপর বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে শুরু হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। ইলেক্ট্রনিকস এবং তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে ঘটে যাওয়া সেই বিপ্লব ডিজিটাল বিপ্লব নামেও পরিচিত। আসে কম্পিউটার, সুপার কম্পিউটার।
বর্তমানে বুদ্ধিদীপ্ত বিভিন্ন ধরনের সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমের উদ্ভবের মাধ্যমে আমরা এগিয়ে চলছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভেতর দিয়ে। এই বিপ্লবের চালিকাশক্তি নানা ধরনের বিকাশমান প্রযুক্তির সংমিশ্রণ। এর মধ্যে যেমন আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস, বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং; তেমন আবার আছে জিন প্রকৌশল, ন্যানোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, থ্রি-ডি প্রিন্টিং, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মতো প্রযুক্তিগুলো।
জ্ঞানভিত্তিক এই বর্তমান বিশ্বে ভিত্তি যদি দুর্বল হয়, বড়জোর আমরা প্রযুক্তির ব্যবহারকারী হতে পারব, প্রযুক্তির উদ্ভাবনকারী হতে পারব না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আর বিজ্ঞানীরাই শুধু চাকরির বাজার দখল করে রাখবেন, ব্যাপারটা সে রকমও নয়। একটি প্রযুক্তি অবলম্বন করে সৃষ্টি হয় অনেকগুলো কর্মসংস্থানের, যেগুলো ক্ষেত্রবিশেষে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে আয়ত্ত করা সম্ভব। যেমন মোবাইল ঠিক করার জন্য সবাইকে ইলেকট্রিক্যাল বা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে হয় না, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকলে পাড়ার মোড়ের দোকানেই ঠিক করে ফেলা সম্ভব। অতএব, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকেন্দ্রিক কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বরাবরের মতোই থাকছে।
পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলোর সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম পার্থক্য হলো এটি আগের বিপ্লবগুলোর তুলনায় অনেক বেশি দ্রুতগতিতে পরিবর্তনশীল, প্রতিটি দেশের প্রায় প্রতিটি শিল্পকে এটি প্রভাবিত করছে। উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, পরিষেবা কিংবা পরিচালনা সবকিছুরই রূপান্তরের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন খাতের ওপর এটুআই প্রকল্প দ্বারা পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ২০৪১ সালের মধ্যে গড়ে এই খাতগুলোতে প্রতি পাঁচজনের দুজন চাকরি হারানোর ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র এবং ফার্নিচার খাতেই ঝুঁকির মুখে পড়বে ৬০ ভাগ চাকরি। তবে, এই সময়ে ৫৫ লাখ চাকরি হারানোর সম্ভাব্য হুমকির বিপরীত দিক হিসেবে ধারণা করা হয়েছে, ১ কোটি নতুন চাকরির সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
একটু ভিন্নভাবে অনেকেই মত দিয়ে থাকেন, বিকাশমান এসব প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন নয়, বরং মানুষকে স্মার্ট করবে, দক্ষ করবে। অ্যামাজন তাদের ওয়্যারহাউজে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখের বেশি রোবট ব্যবহার করেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন লাখ কর্মীর শিক্ষা এবং দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাজেটের ঘোষণা দিয়েছে। সামনের সময়গুলোতে চাহিদা বাড়বে, যেমন চিকিৎসা সহকারী, পরিসংখ্যানবিদ, সফটওয়্যার প্রকৌশলী, নার্সিং এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্ব প্রদান করবে।
অধিকাংশ মানুষই পণ্য কেনার পর যত দ্রুত সম্ভব টাকা পরিশোধ করে চলে যেতে চান। বর্তমানেই স্বয়ংক্রিয় চেকআউট মেশিনগুলো নির্ভুলভাবে এবং অতি দ্রুত টাকা হিসাব করা ও গ্রহণ করার কাজটি সুন্দরভাবে করে যাচ্ছে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই, নিকটবর্তী ভবিষ্যতে লেনদেনের জন্য একজন ক্যাশিয়ার রাখা ও তার বেতন দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।
খাদ্য আমাদের অন্যতম প্রধান মৌলিক চাহিদা। আর খাদ্য উৎপাদনে কাজটি করে থাকেন একজন কৃষক। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবিকার উৎস কৃষিকাজ। কিন্তু কৃষি প্রকৌশলের উন্নতি ও আধুনিকীকরণের ফলে খুব শিগগিরই কৃষিতে মানুষের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। ড্রোনের সাহায্যে জমির পরিমাণ নির্ণয়, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে বীজ বপন, ফসল কাটা, গাছ থেকে ফসল আলাদা করা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করা হবে। ফলে, এসব আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে মাত্র একজন কৃষকই বিপুল পরিমাণ জমিতে কৃষিকাজ করতে পারবেন। বর্তমানে, আমাদের দেশেই বীজ বপন, ফসল কাটার যন্ত্রের ব্যবহার অল্পবিস্তর শুরু হয়েছে।
এমতাবস্থায় এই জনশক্তিকে বোঝা না বানিয়ে সম্পদে পরিণত করার সময় এসেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকেন্দ্রিক কৌশল ঘোষণা দিয়েছে। যেখানে ডিজিটাল গভর্ন্যান্স ও সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং সমাজের ডিজিটাল রূপান্তরের মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু। প্রায় অর্ধযুগ ধরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে আলোচনা চলছে, আয়োজিত হচ্ছে ওয়ার্কশপ, সেমিনার। কিন্তু সে অনুযায়ী যে পরিকল্পনা, দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদে যে কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা ছিল, সেটি আশানুরূপভাবে দেখতে পাওয়া যায় না।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
raihan567@yahoo.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.