ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
৫৪ বছর আগে আজকের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ আইয়ুব সরকারের পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচির মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি পুলিশের গুলিতে জীবন দেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মানুষ সে সময় ভয় ভুলে গিয়ে পথে নামে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী সেই সাহস আর প্রতিবাদের ভাষায় উজ্জীবিত হয়ে বের করে এক শোক মিছিল। একে একে তাতে যোগ দেয় ছাত্র, সাধারণ মানুষ, ছোট-বড় অফিস আদালতের কর্মচারী সবাই। দুই মাইল দীর্ঘ এই মিছিল শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করেছিল সেদিন আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে। আসাদের শার্ট হয়ে ওঠে প্রাণের পতাকা। কবি শামসুর রাহমান লিখে ফেলেন তার অমর কবিতা আসাদের শার্ট। কবি লিখলেনÑ গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/ উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
আসাদের মৃত্যুর খবরে ঢাকার বাইরেও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। যার পরিণতিতে ঘটে গেল ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান, আইয়ুব খানের পতন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ অন্য আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তিলাভ। এই অভ্যুত্থান শ্রমিক ও কৃষকের মধ্যেও বিপুলভাবে জাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
শহীদ আসাদ ১৯৪৯ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার ধানুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আবু তাহের। শহীদ আসাদের পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ। তবে তিনি শহীদ আসাদ নামে পরিচিত। আসাদ শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে জগন্নাথ কলেজ ও মুরারী চাঁদ মহাবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি বিএ ও এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। শহীদ আসাদ তৎকালীন ঢাকা হল শাখার পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে দুই ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগ ও এনএসএফের একাংশ নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরে ১৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেই ১১ দফা সারা দেশে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিল। ১১ দফা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ১৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পরে ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করা হয়েছিল। ১৮ তারিখের মিছিলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। পরদিন (১৯ জানুয়ারি) মিছিল বের হলে আসাদুল হক নামে একজন (তিনি শহীদ আসাদ নন) গুলিবিদ্ধ হন। ২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে মিছিলটি বের হয়েছিল, তার প্রথম সারিতে ছিলেন আসাদুজ্জামান আসাদ। চানখাঁরপুল মোড় থেকে পুলিশের জিপ থেকে আসাদকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছোড়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে আসাদের রক্তমাখা প্রাণহীন দেহ রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে।
আসাদের মৃত্যুতে সারা দেশে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা। আসাদ ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) অন্যতম নেতা। একই সঙ্গে কৃষক আন্দোলনের সংগঠক (প্রধানত শিবপুর এলাকায়) এবং গোপন কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসাদ যেখানে নিহত হয়েছিলেন তার পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের চেষ্টা করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত স্মৃতিস্তম্ভটি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। শহীদ আসাদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার স্মৃতিস্তম্ভ স্মৃতির ধুলায় আচ্ছন্ন। বছরের এই একটি দিন ছাড়া সারা বছর অযত্নে পড়ে থাকে তা। স্মৃতিস্তম্ভটি পরিচ্ছন্ন রাখতে খুব একটা উদ্যোগ দেখা যায় না কখনো। স্তম্ভের ভেতরে কাগজ, বোতল পড়ে থাকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দেখা যায়, লাল-সবুজের রঙের তুলির আঁচড় দিচ্ছেন একজন। স্মৃতিস্তম্ভের উপরে রক্তবর্ণে চকচক করে তোলা হয়েছে। আশপাশের কিছুটা জায়গাও পরিষ্কার করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের পাশে চা বিক্রেতা মাসুদ বলেন, আমি গত চার-পাঁচ বছর এখানে চা বিক্রি করি। এখন যেভাবে পরিষ্কার করা হয় সারা বছর এমন থাকে না। একটু আবর্জনার মতো থাকে। এখন যেমন পরিষ্কার করা হয়েছে, এরকম আবার আরেক বছর আসলে করবে।
আমিনুল নামে আরেক বিক্রেতা বলেন, এখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ আছে আজকে জানলাম। কখনো খেয়াল করিনি। সকালে এসে দেখি পরিষ্কার করছে। পরে সকাল ৯টার দিকে কয়েকজন এসে দেখলাম রং লাগাচ্ছে। একজন এসে বলেছে কালকে যেন এখানে না বসি।
একই অবস্থা মোহাম্মদপুর এলাকায় আসাদের নামে নির্মিত তোরণের। তোরণটি এখনো আছে, কিন্তু পোস্টারে ঢাকা পড়েছে এর সৌন্দর্য। অথচ এই তোরণে পোস্টার সাঁটানো যে দণ্ডনীয় অপরাধ, তা স্পষ্ট করেই লেখা আছে সেখানে।
এখন পর্যন্ত আসাদের স্মৃতিসৌধ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শহীদ আসাদ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান মিলন। তিনি বলেন, এত বছর পর এসেও নিজেকে খুব লজ্জিত লাগে। কারণ এত বছর পার হয়ে গেলেও আসাদের নামে এখন পর্যন্ত কোনো স্মৃতিসৌধ হয়নি। আসাদ যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তার পাশে একটা স্মৃতিসৌধ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছি। কিন্তু বর্তমান সরকার আসার পরে সেটা স্থগিত হয়ে যায়।
আসাদ দিবস উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অনন্য মাইলফলক।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে শহীদ আসাদের এ অসামান্য অবদান দেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে শহীদ আসাদসহ বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারী সকল শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বলেন, গণঅভ্যুত্থানে আত্মত্যাগকারী শহীদ আসাদ এদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার আত্মত্যাগ সবসময় আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রেরণা জোগাবে।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.