মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মুসলমানদের মধ্যে সত্যের পরিবর্তে মিথ্যা অবলম্বন করে চলা মানুষ সমাজে আগেও ছিল, এখনো আছে। মিথ্যা বলা, মিথ্যা লেখা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া থেকে শুরু করে মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়ার মন্দ প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। নানা সময়ে মিথ্যার প্রচার-প্রোপাগান্ডার সয়লাবে দেশে-বিদেশে বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটেছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দীর্ঘদিন যাবৎ ইসরায়েলি হানাদার বাহিনী মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করছে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে। তদ্রুপ দেশেও নানাবিধ মিথ্যা ও অসত্য বক্তব্য দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ কিংবা দখল করা হচ্ছে। একইভাবে ব্যক্তি পর্যায়েও চলছে দমন-নিপীড়ন ও অত্যাচার। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সত্য এসেছে মিথ্যা নির্মূলের জন্য। মিথ্যার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।’ -বনি ইসরাঈল : ৮১
বাংলাদেশকে আল্লাহতায়ালা নিয়ামতে ভরপুর করে দিয়েছেন। আমাদের মাটি ভালো, মিঠা পানি এবং সামুদ্রিক লোনা পানি আছে। আছে দক্ষ জনশক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদও রয়েছে। শুধু দরকার সততার সঙ্গে সম্পদগুলো কাজে লাগানো। দলমত-নির্বিশেষে, জনগণকে কোনো ধরনের ধোঁকায় না ফেলে কাজগুলো করতে পারলে বরকত মিলবে। দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাতে পারবে।
মনে রাখতে হবে, জীবন চলার পথে মানুষ ভুল করে। কিন্তু ভুল আর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জীবন পরিচালনা এক বিষয় নয়। মানুষের ভুল হতেই পারে, ভুল স্বীকার করে নেওয়া মহৎ গুণ। মহান আল্লাহ ভুল স্বীকারকারীকে মাফ করে থাকেন। কিন্তু মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াকে মাফ করবেন না। তাই কোনো অবস্থাতেই অসত্য পথে চলা যাবে না।
ব্যক্তিগত হোক কিংবা পারিবারিক, সামাজিক হোক আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে- কোথাও অসত্য কথা বলার সুযোগ নেই অথবা অসত্য হয় এর অনুমোদন দেওয়া যাবে না। সততার সঙ্গে, জবাবদিহির মানসিকতা নিয়ে দেশ ও দশের কাজ করতে হবে। দুনিয়ায় এর ফল পাওয়া যাবে। আখেরাতেও এর ভালো ফল পাওয়া যাবে।
আমাদের প্রশাসনের নিম্ন ইউনিট ইউনিয়ন পরিষদ অফিস, থানা, উপজেলা, আদালত, জেলা, বিভাগ, এমপি-মন্ত্রীসহ সর্বক্ষেত্রের দায়িত্বশীলরা সততার সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে- আমাদের মতো এই গরিব দেশ উপকৃত হবে।
সততাকে বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় বস্তুর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এর পেছনে হাজারটা কারণ আছে। কিন্তু এটা যে সমাজের জন্য অশনি সংকেত, তা বুঝতে পারছি না। মুরব্বিরা এখন ছোট কাউকে দেখলেই দোয়া করেন, ‘সৎ হও বাছা, ভালো মানুষ হও।’ কথা হচ্ছে, সৎ কী হতে হয়? কোনো মানুষ কি কখনো অসৎ হয়ে জন্ম নেয়? না, অসৎ হয়ে কেউ জন্ম নেয় না। বরং নিষ্পাপ শিশু তার বয়স বৃদ্ধির সময়ে পরিচিত-অপরিচিতজনদের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা এবং সামাজিকতার হাজার নিয়মে যখন বাঁধা পড়তে থাকে, তখনই তার জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে হয়।
এই নির্দিষ্ট লক্ষ্য সহজে জয় করা সম্ভব না। হাজারও প্রাপ্তি দিয়ে জীবন সাজানোর জন্য দুনিয়ার কঠিন বাস্তবতার কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে এসব মানুষের মধ্য থেকেই কেউ কেউ লোভ-লালসা-মোহ ইত্যাদির কারণে প্রবৃত্তির স্বাভাবিক সততার পথ ছেড়ে অসততার দিকে পা বাড়িয়ে দেয়।
সততা ছোট তিন অক্ষরের একটি শব্দ। যা মানব চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ এবং এর প্রয়োজনীয়তা সীমাহীন। এ গুণ যার মধ্যে আছে বা যে এই গুণ অর্জন করতে সক্ষম হন, আল্লাহতায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। সত্যিকার মুমিন সততাকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকেও ঊর্ধ্বে মনে করেন। কেননা তারা জানেন, এটি ইমান ও ইসলামের পূর্ণতা দান করে।
সততা ও বিশ্বস্ততার প্রতি আহ্বান জানিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’ -সুরা আত তওবা : ১১৯
সততা অন্তরের প্রশান্তি লাভের সঙ্গে সঙ্গে পরকালে মুক্তিলাভ, জান্নাত অর্জন, খোদার সন্তুষ্টি এবং ধনসম্পদে বরকতের মাধ্যম। মহান আল্লাহ মানবসমাজকে যে সীমারেখায় চলতে নির্দেশ দিয়েছেন, এগুলোর মধ্যে সততা অন্যতম।
সততা শুধু মুসলমান নয় বরং প্রত্যেক মানুষের জীবনেই প্রয়োজন, সে ইসলামের অনুসারী হোক বা অন্য ধর্মের, নেককার বা বদকার, অফিসার কিংবা কর্মী, শিক্ষক বা ছাত্র ,পীর কিংবা মুরিদ, ধনী হোক বা গরিব, পিতা-মাতা হোক বা সন্তান। মোটকথা, মানবজীবনের প্রতিটা বিভাগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো- সততা।
মানবসমাজের নিরাপত্তা, প্রশান্তি, সুখ-শান্তি, বিনির্মাণ, উন্নতির ভিত্তি- এই সততা। এ কারণেই সততাকে আপন করে নিতে গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। এই গুণ মানুষকে উন্নত, আদর্শ ও নৈতিকতায় ভূষিত করে এবং এর মাধ্যমেই ইসলামি জীবনের পূর্ণতা আসে এবং অর্জিত হয় মানবতার সর্বোচ্চ গুণ।
যদিও সততার পথ কঠিন। সামান্য কিছু অর্জনের আশায় কিংবা ক্ষুদ্র স্বার্থে খুব সহজেই আমাদের চরিত্র থেকে সততা ধীরে ধীরে চুরি হতে শুরু করে। সততার বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, মানুষ বলতে শুরু করেছে, এখন কেউ নাকি সৎ নয়। তাই কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে যদি বলা হয়, এই লোকটি এখনো ভীষণ সৎ তবে লোকজন এমন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাবে যে তারা অদ্ভুত কিছু একটা দেখছে! আসলে সত্যি কথা এটাই, সততা নিয়ে থাকতে হলে স্বার্থ-লোভ-মোহ এসব ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু এই ত্যাগের পথটা বড়ই বন্ধুর!
কিন্তু ইচ্ছা ও চেষ্টা করলে সৎ থাকা মোটেও কষ্টকর কিছু নয়। মানুষের জীবনযাপন এবং চাহিদার মাপকাঠিই নির্ধারণ করে দেয়, আপনি কতটুকু সৎ থাকতে পারবেন কি আদৌ পারবেন না। নিজের ভেতরে থাকা অসততার শেকড়গুলো উপড়ে ফেলে আপনি খুব সহজেই সৎ মানুষের কাতারে পৌঁছে যেতে পারেন।
এ জন্য দরকার, নিজের মনে থাকা সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-, অন্যায়-অনিয়ম, মোনাফেকি, মিথ্যাচার, প্রতারণাসহ যাবতীয় অনাচার ভুলে সততার সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, অবশ্যই আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব। আর অবশ্যই আমরা তাদের তারা যা করত তার তুলনায় শ্রেষ্ঠ প্রতিদান দেব।’ -সুরা নাহল : ৯৭
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.