মোস্তফা কামাল:
বাংলাদেশে নির্বাচনের ঢোলে বাড়ির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানার বাইরেও। সুষ্ঠু ভোটের দাবির সঙ্গে ওয়াদাও তুঙ্গে। লক্ষণীয় বিষয়, এ দাবি ও ওয়াদার বেশির ভাগই বিদেশিদের কাছে। বিএনপির বিদেশিদের কাছে নালিশ রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচিত। সেই সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিটি স্থানিকের আওতা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক করে দেওয়ার চেষ্টাও ব্যাপক। যার অর্থ, সুষ্ঠু-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়, এটি গোটা দুনিয়ারও বিষয়। এর বিপরীতে সরকারের শীর্ষমহল থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওয়াদা শোনানো হচ্ছে বিদেশিদের। কিছুদিন ধরে যেসব বিদেশি হাই-প্রোফাইল এসেছেন তাদের সবাইকেই আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস শোনানো হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের বিচারের তালগাছটা প্রকারান্তরে বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে কি না প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কথাটি কেন সরকারি মহলকে বিদেশি অতিথিদের কাছে অবিরাম বলতে হচ্ছে? নির্বাচন প্রশ্নে বিদেশিদের কোনো কথা শোনা হবে না বলে আওয়ামী লীগের সাহসী ও স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। না শুনলে সেই বিদেশিদেরই কেন সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিতে হচ্ছে? ক্ষমতাসীনদের ঘোষণায় বিদেশিরা দমেনি। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নির্বাচনের কথা আনছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আবার নতুন করে বলা শুরু করেছে। যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপানও সুষ্ঠু নির্বাচনের নসিহত করছে। সরকার বা সরকারি দল তা অগ্রাহ্য করছে না। বলছে না, এসব সবক তারা শুনবে না। উপরন্তু, কথা দিচ্ছে। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওয়াদা দিচ্ছে। বিষয়টি একদিকে সাংঘর্ষিক, আরেক দিকে বিএনপির জন্য বেশ পুলকের। দলটিকে নির্বাচনে এনে দিতে মার্কিন সহায়তা চাওয়ার তথ্য মাস-দশেক আগে নিজেই প্রকাশ করে উটকো ঝামেলায় পড়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। মাস কয়েকের ব্যবধানে এখন বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সরকারের নানা পদক্ষেপ ওপেন সিক্রেটের মতো।
নির্বাচনে আসা যেকোনো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। আবার না আসার স্বাধীনতাও নিশ্চয়ই আছে। এ দায়িত্ব ও স্বাধীনতা দুটিই আপেক্ষিক ও যুক্তির বিষয়। কোনো দলকে নির্বাচনে আনা সরকারের দায়িত্ব না হলেও দায় রয়েছে। এখানে পারস্পরিক আস্থার বিষয় রয়েছে। যে জায়গায় চরম ঘাটতি। এর ফাঁকে বিদেশিদের সালিশ বা মধ্যস্থতার নমুনাও বেশ স্পষ্ট। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনী বল বিদেশিদের পায়ে বা কোটে চলে যাওয়া কারও জন্য শঙ্কার, কারও জন্য সম্ভাবনার।
সরকারের ভালো কিছুই দেখছে না বিএনপি। বিশেষ করে নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের ওপর জিরো পারসেন্ট আস্থাও নেই বিএনপির। তারা এ সরকারের অধীনে নির্বাচন করে দেখেছে। নির্বাচন না করেও দেখেছে। সরকার যেন নির্বাচন করতে না পারে সেই চেষ্টাও বাদ দেয়নি। কোনো অভিজ্ঞতাই সুখকর হয়নি বিএনপির জন্য। তাহলে সামনে কোনটি করবে? বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে, তাদের ছাড়া আগামী নির্বাচন করতে পারবে না সরকার। কোন ভরসায় এমন আশাবাদ দলটির? এক কথায় জবাব নেই তাদের কাছে। রাজনীতি বিশ্লেষকদের কাছেও জবাব নেই। রাজনীতির চেয়েও এটি বেশি হয়ে পড়েছে কূটনীতির বিষয়। আবার এ কথাও সত্য, দেশি-বিদেশি যেকোনো মধ্যস্থতায়ই হোক, একটি সমঝোতা যে আবশ্যক তা বলার অপেক্ষা রাখে না, যা রাজনীতিকে নিয়ে যাচ্ছে কূটনীতির বাঁকে।
এ দেশের নির্বাচন বা কোনো ইস্যুতে বিদেশিরা কেন নাক গলাবে? এমন একটি তাত্ত্বিক প্রশ্ন রয়েছে বরাবরই। আবার দেশ ভাগ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, আন্দোলন, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের নানান ঘটনায় ছিল বিদেশি সম্পৃক্ততা। তা কারও জন্য স্বস্তির, আর কারও জন্য হয়েছে বেদনার। ওই স্বস্তিবোধ করা বেনিফিশিয়ারিরাও পরে প্রয়োজনে বিদেশি ভূমিকার নৈতিক সমালোচনা করেন। আর বেদনাহতরা বিদেশি নেক নজরের নানা চেষ্টা চালান। গোটা বিষয়টাই এক অর্থে আপেক্ষিক এবং যার যার সুবিধামতো। টানা গত কয়েকটি নির্বাচনের সময় দেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকা এমনকি প্রকাশ্য তৎপরতা চলেছে। আজকের ক্ষমতাসীনরা এর সব চেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি। তখন এই বিদেশিদের পরম বন্ধু, উন্নয়ন সহযোগী, গণতন্ত্রের সহায়কসহ নানা বিশেষণ ও সম্বোধনে বিশেষায়িত করা হয়েছে। কূটনীতিকরা কোথায়, কার সঙ্গে কথা বলছেন, কী মন্তব্য করছেন এসব খবরের দিকে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ। গণমাধ্যমকর্মীরাও ব্যস্ত থাকেন ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের তথ্য জোগাড়ে। এবারের পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা। কথাবার্তা বেশি। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলে এ বিষয়ে খুব অসহিষ্ণুতা। অস্থিরতাও প্রকাশ্যে। তাদের কাছে এটি ‘দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ’, যা প্রকারান্তরে সরকারের দ্বিমুখিতা।
ঘটনা বিচারে গত দু-তিনটি নির্বাচনের পূর্বাপর ও নির্বাচন চলাকালে কোনো কোনো বিদেশি কূটনীতিক, যা করেছেন সেই তুলনায় এবার এখনো কম। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে শুধু প্রভাবিত নয়, অনেকটা ধরে-বেঁধে আওয়ামী লীগের সঙ্গী করতে ভারতের তখনকার পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের ভূমিকা স্মরণযোগ্য। এবার এখন পর্যন্ত সে রকম কিছু না হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন জানিয়েছেন, এ সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে তিনি ভারতের সাহায্য চেয়েছেন। এরই মধ্যে ভারতও কথা দিয়েছে, তারা আছেন সরকারের সঙ্গে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিএনপিকে নির্বাচনে এনে দেওয়ার তদবিরের কথাও জানা হয়েছে ড. মোমেনের জবানিতেই।
সচরাচর কোনো রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত দেশে একজন রাষ্ট্রদূত বা অ্যাম্বাসাডর স্বাগতিক দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে নিজের রাষ্ট্রের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করবেন, সেটাই তার দায়িত্ব। তিনি তার দেশের স্বার্থই দেখবেন। কিন্তু বাংলাদেশে বরাবরই ওই কূটনীতিককে তার জায়গায় রাখা হয় না। ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন উভয়ই তাকে মুরুব্বির কেদারায় বসিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেরা লাভবান ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে তৎপরতায়। তাকে নাক গলানোর যাবতীয় কূটনৈতিক বন্দোবস্ত রাজনীতিকরা করে দিচ্ছেন। ব্যবসায়ী-আমলাসহ অন্যান্য সেক্টরও পিছিয়ে থাকে না। দূতাবাসের একটি দাওয়াত পেতে, দূতের মন পেতে হেন চেষ্টা নেই, যা না করা হয়। তখন তারা ‘নাক গলানো’ শব্দ মনে রাখেন না। শুধু নাক নয়, নিজের গলা পর্যন্ত দিয়ে ফেলেন।
আমরা কেন আমাদের নিয়ে বিদেশিদের নাক গলাতে বা আগ্রহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করি? এমন প্রশ্নে খুব বেজার হন রাজনীতিকরা। বিদেশিরা তাদের কদর বুঝে তা নিশ্চিত হতেও প্রায়ই ঢুঁ মারার মতো সফরে আসছেন এ দেশে। যাত্রাবিরতির নামেও আসেন। আমাদের দেশে তাদের গুরুত্বের সঙ্গে চাহিদাও তৈরি হয়েছে। সামনে এ সফর আরও বাড়বে সেই আভাসও রয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের সমান্তরালে বাংলাদেশে রাজনীতির বিভাজনও তাদের জন্য উপকার। নাক ডাকার সঙ্গে কথা বলার মঞ্চ পর্যন্ত তৈরি করে দেয়ওা হচ্ছে এ দেশে। বিদেশিদের দিয়ে মঞ্চের নিরপেক্ষতা, সৌন্দর্য, আভিজাত্য তৈরির একটি চর্চাও চলছে। আর নিউজ কাভারেজ তো উপরি পাওনার মতো। সেখানে আসার পর গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে তাদের নানা প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়। তারা এড়িয়ে যান না। জবাব দেন নিজেদের মতো। লক্ষ করার মতো বিষয় তাদের রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ কবে থামবে, কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে বিশ্ব অর্থনীতি, ওই বিদেশি দূতের দেশে রাজনৈতিক-সামাজিক চিত্র কেমন; এ ধরনের প্রশ্ন করা হয় না। বরং জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রশ্ন। স্বাভাবিকভাবেই এটি তাদের জন্য সুযোগ। গরজ না থাকলেও এর মধ্য দিয়ে তাদের আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আগ্রহী হতে বাধ্য করা হচ্ছে।
এসবের যোগফলে আমাদের দেশের সুষ্ঠু নির্বাচন, ক্ষমতায় বসানো-নামানো-দমানোসহ নানান কাজের কৃতিত্বটা তাদের ঝুড়িতে তুলে দেওয়ার এ প্রবণতা কমার আলামত নেই। বরং আরও বৃদ্ধির কারণ ও পরিস্থিতি বিদ্যমান, চলমান। ক্ষমতায় যেতে তাদের কৃপা, টিকে থাকতে তাদের দয়া, ক্ষমতা থেকে নামাতে তাদের মহানুভবতার এ সন্ধিক্ষণ সামনে আরও কত দূর গড়াবে এখনই বলা যাচ্ছে না। অতীত-বর্তমানের বহু ঘটনায় প্রমাণিত বিদেশিরা কোনো বিষয়ে বেশি পদক্ষেপ নিলে ফলাফল নানান দিকে চলে যায়। পক্ষে-বিপক্ষে দুদিকেই উপাদান তৈরি হয়। যার নানা দৃষ্টান্ত এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে অতি উৎসাহ ও অতি বিরোধিতার ফলও এরই মধ্যে স্পষ্ট। গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলামের বাসায় তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য গেলে সেখানে সরকারি মহলের যোগসাজশে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির ফল ভুগতে হচ্ছে। আবার তাকে অ্যাকটিভ করার জেরও পড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের পরামর্শ ও নানা তাগিদের পেছনে রয়েছে অনেক উদ্দেশ্য-বিধেয়। ভারত-চীনের তো আরও বেশি।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
mostofa71@gmail.com
সূত্র: দেশ রূপান্তর/ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.