শায়খ ড. আবদুল্লাহ আল বুয়াইজান:
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার জিকির নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম মাধ্যম, মহৎ সৎকর্ম ও শ্রেষ্ঠ ইবাদত এবং স্থায়ী সৎকাজের অন্তর্গত। এর মাধ্যমেই মানুষের মর্যাদা সমুন্নত হয়, নেকি বৃদ্ধি পায় ও পাপ মোচন হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী নারী- তাদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।’ -সুরা আল আহজাব : ৩৫
মহান আল্লাহর কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র জিকির হলো- তাওহিদের কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ’র জিকির। এ বাক্যটি ইসলামের প্রতীক এবং শিরক ও ইমানের মধ্যে পার্থক্যকারী। এটা জান্নাতের চাবি ও মূল্য এবং রবের পথে বান্দার অগ্রসর হওয়ার সোপান। এর জন্যই আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করেছেন, রাসুলদের প্রেরণ করেছেন এবং কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছে স্বীয় নির্দেশে রুহ অহিসহ ফেরেশতা পাঠান এই বলে যে, তোমরা সতর্ক করো, নিশ্চয় আমি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; কাজেই তোমরা আমার ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করো।’ -সুরা আন নাহাল : ০২
তাওহিদের কালেমা হচ্ছে- ইসলামের দুর্গ। এর মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি তার রক্ত, সম্পদ ও সম্মানের হেফাজত করতে পারে। এটা ইসলামের পাঁচটি রুকন বা স্তম্ভের প্রথম রুকন। হজরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। আল্লাহ ছাড়া সত্য ইলাহ (উপাস্য) নেই এবং নিশ্চয় মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল, এ কথার সাক্ষ্য দান, নামাজ কায়েম করা, জাকাত দেওয়া, বায়তুল্লায় হজ আদায় করা এবং রমজান মাসের রোজা পালন করা।’ -সহিহ বোখারি
এই কালেমা মহান আল্লাহ কর্র্তৃক ফরজকৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়েই আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে কিতাব নাজিল হয়েছে। দুনিয়ায় আগত সব নবী-রাসুল এর ওপর ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। স্বয়ং আল্লাহ নিজেই এ কালেমার সাক্ষ্য দিয়েছেন। অনুরূপভাবে ফেরেশতাম-লী ও তার মনোনীত জ্ঞানী ব্যক্তিরাও এ সাক্ষ্য প্রদান করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয় তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ (উপাস্য) নেই। আর ফেরেশতারা এবং জ্ঞানীরাও, আল্লাহ ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ -সুরা আলে ইমরান : ১৮
সবচেয়ে মহৎ বিষয় যাকে হৃদয় ধারণ করে ও সংকল্প করে, বান্দা সেটাকে লক্ষ্য স্থির করে ও তদানুযায়ী আমল করে এবং শ্রেষ্ঠ কালেমা যা মুখে উচ্চারিত হয়। তা হলো- ‘এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই, আর মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল।’ এটা সৌভাগ্য ও নাজাত লাভের মাধ্যম এবং এতেই বান্দার ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা নিহিত। এটা আমল কবুলের শর্ত এবং আল্লাহর কাছে পবিত্রতম আমল। এটা শ্রেষ্ঠ আমল, উত্তম কথা ও পরিণামে শ্রেষ্ঠ প্রতিদানযোগ্য আমল। ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর নবী হজরত নুহ (আ.)-এর ইন্তেকালের সময় উপস্থিত হলে তিনি তার পুত্রকে বলেন, আমি তোমাকে একটি উপদেশ দিচ্ছি। তোমাকে দুটি বিষয়ের আদেশ দিচ্ছি এবং দুটি বিষয়ে নিষেধ করছি। তোমাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র নির্দেশ দিচ্ছি। কেননা, সাত আসমান ও সাত জমিনকে যদি এক পাল্লায় তোলা হয় এবং অপর পাল্লায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তোলা হয়, তবে সেই তাওহিদের পাল্লাই ভারী হবে। সাত আসমান ও সাত জমিন যদি একটি জটিল গ্রন্থির রূপ ধারণ করে, তবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তা চুরমার করে দেবে। তোমাকে ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি’র নির্দেশ দিচ্ছি। কেননা এটা প্রত্যেক বস্তুর তাসবিহ এবং সবাই এর বদৌলতে রিজিক লাভ করে। আর আমি তোমাকে বারণ করছি শিরক এবং অহংকারে লিপ্ত হওয়া থেকে।’ -মুসনাদে আহমাদ
ব্যক্তির আমলনামায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ই সবচেয়ে ভারী আমল এবং এটা ইমানের শ্রেষ্ঠ শাখা। আল্লাহর জিকিরে অন্তর প্রশান্তি লাভ করে, কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদাপদ লাঘব হয় এবং গোনাহ মোচন হয়। কাজেই বেশি বেশি আল্লাহর জিকির এবং সর্বদা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করা। কেননা এটা আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ আমল। কাজেই আপনারা তাকওয়া অবলম্বন করুন এবং কালেমায়ে তাওহিদের যথার্থ মূল্যায়ন করুন, এর ফজিলতকে গুরুত্ব দিন এবং এর পরিপন্থী বিষয়সমূহ পরিহার করে চলুন। যাতে আপনারা ইহকাল ও পরকালে নিরাপত্তা লাভ করতে পারেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা ইমান এনেছে এবং তাদের ইমানকে জুলুম (শিরক) দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত।’ -সুরা আল আনআম : ৮২
কোনো বান্দা আল্লাহর জিকির থেকে এমন কোনো বড় আমল করেনি যা আল্লাহর আজাব থেকে অধিক নাজাত দানকারী। আর যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করে, সে কখনই জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে না। হজরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমি এমন একটি কালেমা জানি, কোনো বান্দা যদি তা সততার সঙ্গে পাঠ করে এবং এর ওপর মৃত্যুবরণ করে, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামকে হারাম করে দেন। সেটি হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’ অপর হাদিসে এসেছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ সেই ব্যক্তির ওপর জাহান্নামকে হারাম করে দেন যে বলে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই। -মুস্তাদরাকে হাকেম
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ওই ব্যক্তিকেও জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করে আনা হবে, যে বলেছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং তার অন্তরে একটি যবের পরিমাণ ইমান অবশিষ্ট আছে। এরপর তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হবে, যে বলেছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং তার অন্তরে সামান্য একটি গমের পরিমাণ ইমান অবশিষ্ট আছে। এরপর তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হবে, যে বলেছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আর তার অন্তরে অণু পরিমাণ ইমান অবশিষ্ট আছে।’ -সহিহ মুসলিম
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ দুটি বিষয়ের দাবি করে- এক. এটা স্বীকৃতি দেওয়া যে, আল্লাহই একমাত্র উপাস্য, তিনি এক। তিনিই একমাত্র প্রতিপালক, অমুখাপেক্ষী। সব কিছুর স্রষ্টা ও প্রতিপালক। কাজেই তিনিই ইবাদতের হকদার। দুই. আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপাসত্ব ও প্রভুত্বকে অস্বীকার করা। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই এবং তিনি ছাড়া কোনো প্রতিপালক নেই।
কেয়ামতের দিন পূর্ণ প্রতিদানপ্রাপ্ত মানুষ সেই ব্যক্তি, যে নবী করিম (সা.)-এর শাফায়াত পেয়ে বিজয়ী হয়েছে। কেননা তিনিই হবেন সেদিন একমাত্র সুপারিশকারী এবং তার সুপারিশ কবুল করা হবে। আর শাফায়াতের অধিক হকদার হবে সেই ব্যক্তি, যে একনিষ্ঠতার সঙ্গে পূর্ণ বিশ্বাসী হয়ে বলে- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই)। ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আমার শাফায়াত লাভে সবচেয়ে ধন্য হবে সেই ব্যক্তি, যে আন্তরিক সদিচ্ছা নিয়ে বলে- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’ -সহিহ বোখারি
কালেমায়ে তাওহিদই সমৃদ্ধ পরিসমাপ্তি। এর দ্বারা মুমিন তার আমলের সমাপ্তি ঘটায়, তার আয়ু শেষ হয় এবং সে তার পরিবার-পরিজনকে বিদায় দেয় ও তার আশপাশে যারা রয়েছে তারা তাকে এর তালকিন (স্মরণ করায়) দেয় যেন সে এটা নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে। হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার শেষ কথা হবে- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে অথবা তার জন্য জান্নাত অবধারিত।’ -মুস্তাদরাকে হাকেম
৩ মার্চ মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা।
অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.