বশির আলমামুন, চট্টগ্রাম:
চিকিৎসায় নৈরাজ্যের বিপরীতে চট্টগ্রামে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আল-মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন নগরীর হালিশহর ফইল্যাতলী বাজার এলকায় গড়ে তুলেছে ৭০ শয্যার করোনা ফিল্ড হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টার। এ ছাড়াও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনও চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা এলাকায় প্রতিষ্টা করেছে ১০০ শয্যার ‘সিএমপি-বিদ্যানন্দ ফিল্ড হাসপাতাল। চট্টগ্রাম নগরের হাসপাতাল কিংবা বেসরকারী ভাবে প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিকগুলো যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের পাশাপাশি সাধারণ রোগীদেরও ফেরত দিচ্ছে, এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতাল ঘুরে যখন রোগীদের মৃত্যু ঘটছে রাস্তায় কিংবা গাড়িতে, ঠিক তার বিপরীতে জেগে উঠেছে সাধারণ মানুষের বিবেক। এরকম হ্নদয়বান জনসাধারণের উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আল-মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নগরীতে গড়ে তুলেছে ফিল্ড হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টার। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)। গতকাল বুধবার (১ জুলাই) থেকে হাসপাতাল দুটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দুটি হাসপাতালেই থাকছে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় মহামূল্যবান সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা।
জানাগেছে নগরীর হালিশহরের ফইল্যাতলী বাজারের পাশে ৭০ শয্যার ‘আল মানাহিল নার্চার জেনারেল হাসপাতাল’র প্রস্তুতির কাজ প্রায় সম্পন্ন। হাসপাতালটিতে ১০টি আইসিইউ শয্যাসহ ৭০ টি শয্যা স্থাপন করা হয়েছে । প্রতিটিতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হবে। এখানে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাও আছে। শিগগির চিকিৎসা সেবায় যুক্ত হবে তিনটি ভেন্টিলেটর।
এদিকে গত জুন মাসের মাঝামাঝিতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ১০০ শয্যার ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছিল বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। হাসপাতালটি নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন বাটারফ্লাই পার্কের বিকে কনভেনশন সেন্টারকে বেছে নেয়া হয়। দুই সপ্তাহ পেরোতেই হাসপাতালটি এখন চিকিৎসা দেয়ার জন্য প্রস্তুত। গতকাল থেকে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে শুরু হয়েছে করোনা রোগীর চিকিৎসা। নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা চারটি ওয়ার্ড নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় বেড স্থাপন, চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয়, পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থাসহ সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আল-মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মাওলানা ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে আমরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গে নিয়ে মৃত ব্যক্তিদের দাফন-দাহ করে আসছি। পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত বা উপসর্গ থাকা ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে অন্যরা যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তখন নিজেদের অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছিলাম রোগীদের। হাসপাতালে পৌঁছে দিতে গিয়ে দেখতে পাই, কোনো কোনো হাসপাতাল রোগীদের ভর্তি করাচ্ছে না। কোথাও চিকিৎসার মাঝপথে রোগীদের বের করে দেয়া হচ্ছিল। আবার কোথাও গিয়ে দেখতে পাই, হাসপাতালে ধারণক্ষমতার বেশি রোগী। ফলে রোগী নিয়ে ঘুরতে অনেকে মারা গেছে রাস্তায়। তাই আমরা নিজেরাই একটি হাসপাতাল গড়ার সিদ্ধান্ত নেই।’
তিনি জানান, হালিশহরের ফইল্যাতলী বাজারের পাশে নাসরিন বাকি নামের এক দানশীল নারী দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়দের চিকিৎসাসেবা দিতে পাঁচতলা ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন অনেক আগে। তার কর্মব্যস্ততার কারণে সময় দিতে না পেরে তিনি সেবা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সেটি আল-মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনকে হস্তান্তর করেন গত বছর। এখন সেই ভবনটিতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘আল মানাহিল নার্চার জেনারেল হাসপাতাল’। করোনা শেষ হলে হাসপাতালটিতে প্রসূতি মায়েদের সেবা দেয়া হবে। পাশাপাশি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্যও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হবে।
আল মানাহিল নার্চার জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট প্রকৌশলী ইফতেখার হাসান জানান, পাঁচতলা ভবনের পুরোটাই করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হবে। এর মধ্যে পঞ্চম তলায় পুরুষ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে। চারতলায় থাকছে আইসিইউ, তৃতীয় তলায় কেবিনের ব্যবস্থা। এছাড়া দ্বিতীয় তলায় নারী-পুরুষের জন্য আলাদাভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নিচতলায় থাকছে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড। আইসিইউ ব্যবস্থার পাশাপাশি রাখা হয়েছে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম।
সাধারণ মানুষের জন্য হাসপাতাল গড়ে তোলার পেছনের গল্প জানাতে গিয়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাশ বলেন, ‘কিছুদিন আগে এক ছবিতে হাসপাতালের বেডের জন্য ঘুরতে ঘুরতে এক রোগীকে রাস্তায় মরতে দেখে খুব হতাশ হই। তখনই মনে হলো যাদের সুযোগ আছে তাদেরই এগিয়ে আসা উচিত। তাই একটা ভালো উদাহরণ তৈরি করতে চাইলাম।’
তিনি বলেন, ‘অনেক মৃত্যু হচ্ছে, আবার ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে অনেকেই বেঁচে যাবেন। মানুষকে অন্তত সম্মানজনক মৃত্যু কি আমরা উপহার দিতে পারি না? যাওয়ার সময় সামান্য যতœ কিংবা অন্তত চোখের জল কি মানুষ পেতে পারে না? সেদিনই সিদ্ধান্ত নিই দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু একটা করার। আজ সেটি বাস্তব হতে চলেছে।’
বিদ্যানন্দের হাসপাতাল প্রস্তুতি কাজের সমন্বয়কারী ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘গতকাল থেকে প্রাথমিকভাবে ৫০ শয্যা দিয়ে শুরু করলেও শিগগিরই ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হবে। প্রতিটি শয্যাকে করোনা চিকিৎসার প্রটোকল অনুযায়ী গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া ডাক্তার-নার্সদের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথও রাখা হয়েছে আলাদাভাবে। ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে ১২ জন চিকিৎসক, ১৮ জন সেবিকা যোগ দিয়েছেন। সবার সহযোগিতা নিয়ে আমরা হাসপাতালের কাজ এগিয়ে নিয়েছি। আমরা পেয়েছি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা অক্সিজেন, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও দুটি অ্যাম্বুলেন্স। পেয়েছি সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেমও। এছাড়া বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের একটি দল ভিডিও কনফারেন্সিংসহ নানাভাবে চিকিৎসাসেবা প্রদান করবে। পাশাপাশি সারাদেশ থেকে আগত বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী হাসপাতালটিতে সেবা দেবেন।’
হাসপাতাল দুটির কার্যক্রম চালুর বিষয়ে সিএমপি কমিশনার মো. মাহবুবর রহমান বলেন, ‘করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের প্রথম থেকেই বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে অবদান রেখে যাচ্ছেন। অপরদিকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আল-মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মহামারির প্রথম থেকেই জনগণের পাশে থেকে মানবিক কাজ করছে। আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসাসেবা আরও বেগবান করার জন্য এ উদ্যোগ, যা নিঃসন্দেহে জনগণকে চিকিৎসাসেবা প্রদানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এ ধরনের উদ্যোগ মানুষকে শুধু চিকিৎসা সেবাই দেবে না, বরং আরও মানবিক হতে উদ্বুদ্ধ করবে।’
চট্টগ্রামে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর পর নগরের ১২ বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বেড ব্যবহারের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু সেটা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। আইসিইউ বেড ব্যবহার তো দূরের কথা, মার্চ মাস থেকে নগরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তিই পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়।
সাম্প্রতিক এক হিসাবে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে করোনা রোগীর জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর ৭৬৮ শয্যার ৩৫০টিই খালি। এর বাইরে প্রত্যেকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি করানোর কথা বলা হলেও প্রকৃত পক্ষে তা হচ্ছে না। তাই এখনো প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে রাস্তায় মৃত্যু ঘটছে মানুষের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থার এমন বেহাল দশায় জেগে উঠেছে সাধারণ মানুষের বিবেক। শুধু আল-মানাহিল ফাউন্ডেশন বা বিদ্যানন্দ নয়, তিন মাস ধরে চট্টগ্রামের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে চলমান চিকিৎসা নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সাধারণ মানুষ নিজেরাই গড়ে তুলছেন ফিল্ড হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টার।
করোনা সন্দেহে বেসরকারি হাসপাতালগুলো যখন রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছে, তখন বিদ্যানন্দ বা মানাহিল হাসপাতাল মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, আগলে নিচ্ছে রোগীকে।
এর মধ্যে সংক্রমণ শুরুর পরপর আমেরিকান ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া ও নাভানা গ্রুপের সহায়তায় সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাটে গড়ে ওঠে করোনা চিকিৎসায় দেশের প্রথম ৬০ শয্যার ফিল্ড হাসপাতাল, চিকিৎসক হোসেন আহম্মদের উদ্যোগে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয় ‘বন্দর ইপিজেড পতেঙ্গা করোনা হাসপাতাল’ এবং নগরের চান্দগাঁও হামিদচর এলাকায় মিনি আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তোলেন তরুণ ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন।
এছাড়া সাবেক কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার প্রচেষ্টায় হালিশহর এলাকায় গড়ে ওঠে ১০০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার, আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরীর উদ্যোগে নগরের বাকলিয়ায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে প্রস্তুত হয় করোনা ডেডিকেটেড আইসোলেশন সেন্টার এবং একই এলাকায় ১০০ শয্যার আরও একটি আইসোলেশন সেন্টার তৈরির উদ্যোগ নেন বিএনপি নেতারা।
অবশ্য করোনার চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় আইসোলেশন সেন্টারটি গড়ে উঠেছে আগ্রাবাদে সিটি হলে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ২৫০ বেডের আইসোলেশন সেন্টারটি গড়ে তুলেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ইতোমধ্যে সেখানে চিকিৎসা শুরু হয়েছে। করোনা সন্দেহে বেসরকারি হাসপাতালগুলো যখন রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছে, তখন এসব ফিল্ড হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টার মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, আগলে নিচ্ছে রোগীকে।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.