জাকির হোসেন :
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে, তার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। ভয়াবহ ওই ঘটনায় তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক তরুণকে। কদিন পর গ্রেপ্তার করা হয় মগবাজার এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের নেতা মোখলেছুর রহমানকে। তাদের ফাঁসাতে না পেরে, পরের বছর ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে ধরে আনা হয় জজ মিয়া নামের এক যুবককে। জজ মিয়াকে ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে একটি সাজানো জবানবন্দি আদায় করেছিল সিআইডি। ২০০৫ সালের ২৬ জুন আদালতে দেওয়া ওই কথিত স্বীকারোক্তিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি, গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না! পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। ওই বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ।
এই জবানবন্দির পর ওই বছর ২৯ জুন দৈনিক প্রথম আলোয় দুটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। একটির শিরোনাম ছিল- ‘এই গল্পের গাঁথুনি দুর্বল/ ‘স্বীকারোক্তিতে সাত অসংগতি’। অপরটির শিরোনাম- ‘সেই জজ মিয়া তারকা সন্ত্রাসী’। সঙ্গে ছাপানো হয়েছিল, শিশির ভট্টাচার্যের কার্টুন ‘আষাঢ় মাস...জমেছে আষাঢ়ে গল্পের আসর’। ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করেছিলেন, জজ মিয়ার ছোট বোন খোরশেদা বেগম। ওই প্রতিবেদনটিও প্রকাশ করেছিল- প্রথম আলো। তিনি বলেছিলেন, জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকে সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে। শিরোনাম ছিল- ‘জজ মিয়ার পরিবারকে টাকা দেয় সিআইডি’। এরপর জোট সরকার আর ‘জজ মিয়া গল্প’ নিয়ে এগোতে পারেনি। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে, এই মামলার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অব্যাহতি দেওয়া হয়- জোট সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হওয়া জজ মিয়া, পার্থসহ ২০ জনকে।
পুরনো ঘটনাটি সামনে আনলাম বলার জন্য যে, এটাই প্রথম আলো। শুধু এ ঘটনা নয় আরও অনেক অনিয়মের ভিত কাঁপিয়েছে পত্রিকাটি। শুধু অনিয়ম কেন- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা ষড়যন্ত্র পত্রিকাটি তুলে ধরেছে সুস্পষ্টভাবে। আজ যারা প্রথম আলোর সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, বোধকরি সাংবাদিকতার বোধ বা চর্চা নেই বলেই করছেন। কারণ কোনটি সাংবাদিকতা, কোনটি সংবাদÑ এ জ্ঞান থাকলে তো আর প্রথম আলো নিয়ে এমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতো না। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এবং সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে আমি তাই মনে করি।
চলুন সাংবাদিকতা পাঠে যাই। গণমাধ্যমকে বলা হয় একটি সমাজের দর্পণ। আমাদের চারপাশের নানান ঘটনার মধ্যে জরুরি এবং ব্যতিক্রম যা সাধারণের জানার আগ্রহ আছে, জানার প্রয়োজন আছে তা গণমাধ্যমে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। একটি সংবাদ একজনের প্রয়োজন মেটায়, একটি সমাজের অসংগতি দূর করে, ইতিহাস ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে। অর্থাৎ মানুষের জানার ক্ষুধা মেটায় সংবাদ। আর সেটা যে মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাই গণমাধ্যম। সংবাদের সংজ্ঞায় জন বোগার্ট বলেছিলেন- কুকুর মানুষকে কামড়ালে সংবাদ হয় না, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তা সংবাদ হয়।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তান আমলে আমাদের গণমাধ্যম ছিল হাতেগোনা। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না বলে সাংবাদিকদের অনেক কৌশলে সংবাদ পরিবেশন করতে হয়েছে এদেশের মানুষের জন্য। স্বাধীনতার পর, মতপ্রকাশে সাংবিধানিক স্বাধীনতা পায় সাংবাদিকরা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পর, আমাদের আবার বন্দি হতে হয় সামরিক শাসনের কব্জায়। ফলে সংকুচিত হয় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। বলা যায়, ৭০ এর মাঝামাঝি থেকে ৮০’র দশকের লম্বা সময় সংবাদ সাংবাদিকতা চলে নানান সেন্সরশিপে। কিন্তু ৯০-এর গণআন্দোলনের পর মুক্তি পায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ফলে বিকাশ ঘটে গণমাধ্যমের। বেসরকারি টেলিভিশনের লাইসেন্স প্রদান এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল আমাদের গণমাধ্যমে যুক্ত হয়। এতে আজ মানুষ খুব সহজেই সব ধরনের খবর তাৎক্ষণিক জেনে যায়। এর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যুক্ত হয়েছে অসাংবাদিক প্লাটফর্মে।
গণমাধ্যমের এই বিকাশের সুযোগে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এবং অসাংবাদিক চলে আসে সাংবাদিকতার পেশায়। তারা লেজুড়বৃত্তিক সাংবাদিকতা শুরু করে স্বার্থান্বেষী মহল ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। ফলে সাংবাদিকতার মান ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আজ যে কেউ এসেই একটি গণমাধ্যমের সম্পাদক হচ্ছেন। অথচ সাংবাদিকতায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্পাদক হওয়ার বিধান নেই। কিন্তু হচ্ছেন। এ কারণে যে কেউ সাংবাদিকতাকে বিকৃত করে সংবাদ পরিবেশন করছেন। নিজস্ব স্বার্থে সংবাদকে প্রভাবিত করছেন। ভুল সাংবাদিকতা দিয়ে সমাজে উসকানি দিচ্ছেন।
সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোর একটি খবর নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে। বিবৃতি পাল্টা বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। প্রথম আলোর নিবন্ধন বাতিলের দাবি করছেন এমন কেউ কেউ। যারা কিনা প্রথম আলোর সুবিধাভোগী। সাংবাদিকতা কী? যার কোনো ধারণা নেই তাদের। ঘটনাটি ছিল গত ২৬ মার্চের। ওই দিন প্রথম আলো অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে প্রকাশের সময় দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি ‘ফটোকার্ড’ তৈরি করা হয়। সেখানে উদ্ধৃতিদাতা হিসেবে দিনমজুর জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ছবি দেওয়া হয় একটি শিশুর। পোস্ট দেওয়ার পর অসংগতি নজরে আসে এবং দ্রুত তা প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি প্রতিবেদন সংশোধন করে, সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখসহ পরে আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়।
এর জের ধরে ২৯ মার্চ ভোর চারটার দিকে প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানের বাসায় যান ১৪ থেকে ১৫ জন। নিজেদের পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্য পরিচয়ে শামসুজ্জামানকে নিয়ে যান। পরদিন জানা যায়, রমনা থানায় একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি। মামলাটি করেছেন একজন আইনজীবী। এ ছাড়া ২৯ মার্চ দিবাগত রাত ২টা ১৫ মিনিটে শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, তেজগাঁও থানায় নথিভুক্ত হওয়া এজাহার অনুযায়ী মামলাটি হয়েছে। বাদীর পরিচয় লেখা হয়েছে, তিনি ঢাকার কল্যাণপুরের বাসিন্দা। তার ফেসবুক পেজে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক। তিনি আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
রমনা থানার মামলায় শামসুজ্জামানকে জেলে যেতে হয়েছে। একই সঙ্গে প্রথম আলোর সম্পাদককে জামিন নিতে হয়েছে উচ্চ আদালত থেকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আসলে অভিযোগটা কী?
আমরা যদি প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্টের দিকে তাকাই, এতে বলা আছে- ‘প্রকাশিত সংবাদ যদি ক্ষতিকর হয় বা বস্তুনিষ্ঠ না হয় তবে তা অবিলম্বে প্রত্যাহার, সংশোধন বা ব্যাখ্যা করা এবং ক্ষেত্র বিশেষে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে’। প্রথম আলো তার সবটাই করেছে। এবার আসি কী ভুল ছিল খবরে। খবরে ভুল বলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে চর্চায় এনেছে। অথচ এটি খবর নয়, একটি ফেসবুক কার্ড। এর দায় শামসুজ্জামানের না। এ দায় প্রথম আলোরও না। ফেসবুকে আমরা অনেকেই আনসেন্সর মন্তব্য করছি। আবার তুলেও নিচ্ছি। যদি আইনভঙ্গের কারণে মামলা হয় তবে প্রতিদিন হাজার হাজার ব্যক্তিকে ডিজিটাল অ্যাক্টের আওতায় দায়ী করা যায়। আর বেসরকারি টেলিভিশন সেটাকে পুঁজি করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যা করেছে, সেটা কাম্য নয়। এর ফলে কী হচ্ছে? এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সাংবাদিকরা বিব্রত হচ্ছেন। সাধারণের কাছে সাংবাদিকতার মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে। এই ঘটনার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে বিবৃতি দিয়েছে। সাংবাদিকতা সম্পর্কে ধারণা নেই বলে আজ শিল্পী সমাজের একটি দল প্রথম আলোর নিবন্ধন বাতিলের দাবি তুলেছেন, যারা বড় মাপের শিল্পী হয়েছেন প্রথম আলোর কাভারেজ পেয়ে।
প্রকাশনার ভুল একটি অতি সাধারণ ঘটনা। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে যখন ভুল থাকে, তখন সেটা শিক্ষার্থীরা গোটা বছর জুড়ে পড়ে। আর গণমাধ্যমের ভুল তাৎক্ষণিক পরিবর্তন করা যায়। পাঠ্যপুস্তকের ভুলের শাস্তি হতে দেখা যায় না। কিন্তু গণমাধ্যমের কথিত ভুলের কারণেও শাস্তির মুখে পড়তে হয়। আমি মনে করি, অপসাংবাদিকতা বন্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকা জরুরি। কিন্তু সাংবাদিকদের বা গণমাধ্যমকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে নয়। গণমাধ্যম সমাজের কথা, রাষ্ট্রের কথা বলে বলেই দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ভুল উপস্থাপনা দিয়ে শেষ করব। করোনা মহামারীর সময় টেলিভিশনের একটি টকশোতে উপস্থাপিকা বলছিলেন, ...আমরা জানার চেষ্টা করব, গেল বছর করোনাভাইরাসে যারা মারা গেছেন এখন তারা কেমন আছেন। আশা করি, তিনি ভুল করেই এভাবে উপস্থাপনা করেছেন। তিনি নিজেও জানেন, মৃতরা কথা বলতে পারেন না। এ বোধটুকু তার আছে। এ কারণে আমি বা আমরা সংক্ষুব্ধ হইনি। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখেছি।
লেখক: সাংবাদিক
zakpol74@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.