সালাহ উদ্দিন শুভ্র:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার গাছ কাটা হবে। কোনো একটি ভবন নির্মাণের জন্য যে জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে সেখানে অনেকগুলো গাছ আছে। ওই জায়গাটা বলতে গেলে জঙ্গল। জঙ্গল সাফ করে ভবন নির্মাণ যেন একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। খোদ ঢাকা শহরেই কয়েকদিন আগে দেখলাম সড়ক বিভাজকের বড় বড় গাছ কেটে ফুল গাছ লাগানো হয়েছে। পত্রিকার খবরে পড়লাম, আরও গাছ কাটার প্রকল্প হাতে রয়েছে সিটি করপোরেশনের।
গাছ কাটার খবর শুনলেই মনে হয় একটি সমাজব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করা হচ্ছে। সাধারণভাবে আমরা জানি, গাছকে কেন্দ্র করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী বসবাস করে থাকে। তবে বিজ্ঞান বলছে, গাছেদের নিজেদেরও সমাজ আছে। শুনতে কিছুটা অদ্ভুত লাগলেও, গাছের যে মন আছে তা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসছে।
গাছের এই সমাজব্যবস্থা নিয়ে বহুল পঠিত একটি বই আছে একজন জার্মান বনবিদ ও লেখকের। তার নাম পিটার ওয়েলবেন। তার বিখ্যাত বইটির নাম ‘দ্য হিডেন লাইফ অব ট্রিস’। এ বইয়ে পিটার ওয়েলেবেন দেখিয়েছেন গাছেদেরও সমাজ আছে। মানুষ যেমন একসঙ্গে অনেকজন বসবাস করে আর এর ফলে সমাজ গড়ে ওঠে, গাছেদেরও তেমনি সমাজ আছে। একসঙ্গে অনেক গাছ মিলে জঙ্গল হয়। এক মানুষ যেমন অরেক মানুষের প্রয়োজনে এগিয়ে আসে, গাছেরাও তেমনি একে অপরের অভাব মেটায়। গাছেদের ভেতর একজন ‘মা’ থাকে, যে তার ‘সন্তানদের’ প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে।
মানুষের সমাজে যেমন একজন বয়স্ক ব্যক্তি থাকে, যাকে সাধারণ অর্থে ‘মুরব্বি’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এই মুরব্বি হন বয়স্ক, অনেক অভিজ্ঞতা থাকে তার। গাছেদের জঙ্গলেও তেমনি কিছু গাছ থাকে ঝাঁকড়া, যাদের অনেক বয়স; তারা নিজেদের পাতাসহ শরীরে জলীয়বাষ্প সঞ্চয় করে রাখে। যা অনাবৃষ্টির সময় অপরাপর গাছেরা ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া গাছ মানে তাকে কেন্দ্র করে অপরাপর প্রাণীরা বসবাস করে, অক্সিজেন ও খাদ্য সংগ্রহ করে। সবমিলিয়ে গাছেরা মিলে একটা প্রাকৃতিক সমাজ তৈরি হয়।
ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়ার অধ্যাপক ও গবেষক সুজানে সিমারড এক গবেষণায় দেখেছেন, গাছেদের মধ্যে শেকড়ের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। কোনো গাছের কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘাটতি হলে অপর গাছ শেকড়ের মাধ্যমে তা সরবরাহ করে থাকে। শেকড়ে শেকড়ে গাছেদের এই যোগাযোগের সময় এক ধরনের শব্দ হয়, যা শুনতে অনেকটা ‘কররর...’ এ রকম।
চলতি বছরের মার্চের শেষে ‘নেচার’ পত্রিকায় একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, আঘাত পেলে গাছ কান্না করে। কোনো কোনো প্রাণী গাছেদের সেই কান্না শুনতেও পায়। শ্রবণসীমার বাইরে থাকায় মানুষ তা শুনতে পায় না। তবে কিছু কিছু প্রাণীর কানে ঠিকই পৌঁছায় সেই কান্না। আর কান্নার শব্দ অনেকটা আঙুলের মটকা ফোটানোর মতো বা কম্পিউটারের কিবোর্ডে টাইপ করার মতো শোনায়।
পিটার ওয়েলবেন তার বইয়ে কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যেমন, উনিশশ সত্তর আশির দিকে বিজ্ঞানীরা দেখলেন যে, আফ্রিকান সাভানায় জিরাফগুলোর প্রিয় খাবার হলো কাঁটাওয়ালা গাছ। যাকে আমাদের দেশে বলে বাবলা গাছ। একবার আফ্রিকার সেই গাছগুলো তাদের পাতায় বিষাক্ত পদার্থ ছড়াতে শুরু করে। এর ফলে জিরাফগুলো আর বাবলা পাতা খেতে পারল না। তারা আশপাশের একশো গজ দূরের গাছে চলে গেল। যে কাঁটাওয়ালা গাছ প্রথম জিরাফদের বাধা দিল সে তার আশপাশের গাছেও বার্তা পাঠাল। যার ফলে অন্য গাছগুলো সংকেত পেল যে তাদের কেউ খেতে আসছে। তারাও তখন পাতায় সেই কষ ছড়াতে লাগল।
অন্য গবেষণায়ও দেখা গেছে, কোনো পোকা যখন গাছের পাতা খায়। তখন ওই গাছ এক ধরনের কষ তৈরি করে পাতায়। ফলে পোকা সম্পূর্ণ পাতা সবসময় খেতে পারে না। গবেষকরা বলছেন, কোনো পোকা যখন পাতা খেতে শুরু করে, তখন গাছের সেটা পছন্দ হয় না। তাদের অনুভূতি এর বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে। তারা তেমনই একটা বিষাক্ত রস ছড়াতে শুরু করে। এখানে যেটা লক্ষ করার বিষয় সেটা হলো, আমরা মানুষরা যত দ্রুত মশা কামড়ালে বা কোনো অস্বস্তি শরীরে তৈরি হলে সাড়া দিতে পারি, গাছের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। গাছ খুব ধীরে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। পাতায় পোকার কামড়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তার ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। শেকড় যদি আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন গাছ পাতার মাধ্যমে এক ধরনের গন্ধ ছড়ায় বলেও বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন।
গাছের প্রাণ থাকার মতো, মন থাকার বিষয়টিও যার গবেষণার মাধ্যমে প্রথম নজরে আসে তিনি জগদীশ চন্দ্র বসু। তিনি লজ্জাবতী গাছ নিয়ে গবেষণা করেন এবং বিশাল এক বইও লেখেন। তার মাধ্যমে গাছেদের যে অনুভূতিপ্রবণতা তা বিজ্ঞানী মহলকে সচেতন করে তোলে।
মন বলতে কোনো আলাদ অঙ্গের অস্তিত্ব মানব বা অন্যান্য প্রাণীর শরীরে উপস্থিত থাকে না। বিজ্ঞানে মন বলতে সামগ্রিক স্নায়বিক ক্রিয়াকে বুঝায়। মানুষ বা প্রাণীর যেমন স্নায়ুতন্ত্র আছে, গাছের অবশ্য তা নেই। না থাকলেও গাছ যে অনুভূতি প্রকাশ করে তা বুঝার অনেক উপায় আছে। তাই রক্ত ঝরে না বলে যখন-তখন গাছ কেটে ফেলা খুবই প্রকৃতিবিরোধী এবং অমানবিক একটা কাজ।
অনেকে গাছের অর্থনৈতিক বা বাস্তুসংস্থানগত গুরুত্বের কথা বলেন। সেগুলো ঠিকই আছে। কিন্তু গাছেরও যে মন আছে, এ বিষয়টা আরও ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এর মাধ্যমে গাছ কাটাসহ তাদের প্রতি যে অপরাপর অন্যায় করা হয়, তার জন্য মানবিক অনুভূতিকে আরও জাগ্রত করার ক্ষেত্র তৈরি হবে। একটি গাছ কাটা হচ্ছে মানে, সে কাঁদছে; এই তথ্য বৈজ্ঞানিকভাবেই এখন প্রমাণিত বিষয়। কোনো গাছ কাটা পড়লে অপরাপর গাছেদেরও সমস্যা তৈরি হবে। প্রয়োজনীয় সাহায্য, বংশবিস্তার রোধ হয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
salahuddinshuvro@gmail.com
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্ত
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.