ইসমাঈল সিদ্দিকী:
ডিভোর্স কোনো সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি কারও জন্যই সুখকর কিংবা আকাক্সিক্ষত ঘটনা নয়। দুটো মানুষ যখন বিয়ের মতো একটি পবিত্র, মধুর বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন দুজনের মনেই স্বপ্ন থাকে যে, এই সম্পর্কটি সাড়া জীবন টিকে থাকবে। এই সম্পর্ক মাঝপথে ভেঙে যেতে পারে এই চিন্তা বা আশঙ্কা কারও কল্পনাতেও আসে না। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে উভয় পরিবারের সবাইও আশা করে এই সম্পর্ক টিকে থাকবে আজীবন। যেকোনো সমাজের ভিত্তি এই বিয়ে নামের সম্পর্কটি। কিন্তু হঠাৎ করেই ডিভোর্সের কারণে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে চিড় ধরে। এতদিনকার সব সুখস্মৃতি ভুলে দুজন দুই ছাদের নিচে বসবাস করতে শুরু করে। দুঃখজনক পরিস্থিতি হলো, বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়েই চলেছে। গত এক বছরে দেশে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশে, যা আগের বছর ছিল ০ দশমিক ৭ শতাংশ। শহরের তুলনায় গ্রাম এলাকায় এই বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২-এর প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক আলমগীর হোসেন।
তিনি জানান, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়েছে। শহরের তুলনায় গ্রাম এলাকায় বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে। দেশে বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ১ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ছিল ০ দশমিক ৭ শতাংশ। এই বিবাহ বিচ্ছেদের হার পল্লী এলাকায় ০ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে বিবাহ বিচ্ছেদের হার দাঁড়িয়েছে ১ শতাংশ।
প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রবণতা কেন বাড়ছে? কেন মানুষ বৈবাহিক জীবন ছেড়ে একাকী জীবন বেছে নিচ্ছে? এটা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানা কারণ বর্ণনা করেছেন। তবে যে কথাটি প্রায় সবাই বলছেন, তা হচ্ছে, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব।
বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবন-দর্শন ও জীবনধারা, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের হক সম্পর্কে সচেতনতা, বিনয় ও ছাড়ের মানসিকতা, সন্দেহপ্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা, পর্দা-পুশিদা রক্ষা করা, পরপুরুষ বা পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক ও মেলামেশা থেকে বিরত থাকা, যৌতুকবিহীন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, শারীরিকভাবে অক্ষম হলে বিবাহ থেকে বিরত থাকা এসবই ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো মানা হয় না বিধায় প্রতিনিয়ত বিচ্ছেদের মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে।
ইসলামে ডিভোর্সের প্রতি নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদের কড়া সমালোচনা করেছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল হচ্ছে তালাক।’ সুনানে ইবনে মাজাহ : ২০১৮
দাম্পত্য জীবনে সামান্য মতের অমিল হতেই পারে। রাগ-অভিমান, মনোমালিন্য থাকতেই পারে। সমস্যা যেমন আছে, উত্তরণেরও তো অনেক উপায় আছে। এ জন্য সাংসারিক জীবনে সমস্যা সৃষ্টি হলে সর্বপ্রথম তা উদ্ভবের কারণ চিহ্নিত করতে হবে। সম্ভাব্য সব সমাধানের পথে বিচরণ করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসের ভিত গড়ে তুলতে হবে। উভয়কেই ছেড়ে দিতে হবে সন্দেহপ্রবণতা।
একপক্ষ মানিয়ে চলবে আর অন্যপক্ষ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করলে ‘শান্তি’ ও ‘সুখ’ নামক শব্দটি সংসার থেকে বিদায় নেবে। এ জন্য দুজনেরই ছাড় দেওয়ার মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে। শরিয়তের নির্দেশনা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষায় প্রয়াসী হওয়ার। তালাক ও বিবাহ বিচ্ছেদের পর্যায়টি হচ্ছে সর্বশেষ পর্যায়, যা অনিবার্য প্রয়োজনের স্বার্থেই বৈধ করা হয়েছে। এ জন্য যথাসম্ভব মনোমালিন্য দেখা দিলে নিজেরাই মিটমাট করে নেবে, যদি তা বড় আকার ধারণ করার আশঙ্কা হয় তখন দুই পরিবার আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে তার (স্বামীর) পরিবার থেকে একজন ও তার (স্ত্রী) পরিবার থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত।’ সুরা নিসা : ৩৫
আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, উভয় সালিশ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মীমাংসা করে দেওয়ার সদুদ্দেশ্য রাখলে আল্লাহ তাদের নেক নিয়ত ও সঠিক চেষ্টার বদৌলতে বনিবনা করে দেবেন। কাজেই বিবাহ বিচ্ছেদের আগে এই কোরআনি শিক্ষা অনুসরণ করা কাম্য। সেই সঙ্গে দাম্পত্য জীবন মধুময় করে তুলতে নিম্নোক্ত উপায়গুলো মেনে চলা যেতে পারে
স্ত্রীর প্রশংসা করা : হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) স্ত্রীদের প্রশংসা করতেন। ভালো কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে থেকে হজরত খাদিজা (রা.)-এর চেয়ে অন্য কোনো স্ত্রীর প্রতি বেশি ঈর্ষাপোষণ করিনি। কারণ, রাসুল (সা.) প্রায় তার কথা স্মরণ করতেন এবং তার প্রশংসা করতেন।’ সহিহ বোখারি : ৫২২৯
দোষ গোপন রাখা : অনেকেই মন খারাপের অবসানের জন্য অন্যের কাছে প্রিয় মানুষের সমালোচনা করে। এতে করে সংসারে কলহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয় এবং সুখ-শান্তি চলে যায়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা অগ্র-পশ্চাতে দোষ বলে বেড়ায়।’ সুরা হুমাজা : ১
গোপনীয়তা ফাঁস না করা : হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সে হবে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট পর্যায়ের, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সঙ্গে মিলিত হয়, অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়।’ সহিহ মুসলিম : ৩৪৩৪
নিজেকে পরিপাটি রাখা : পুরুষরা তাদের সঙ্গিনীকে সুন্দরভাবে দেখতে পছন্দ করে। ঠিক একইভাবে তারা তাদের সঙ্গীকেও সুন্দরভাবে দেখতে পছন্দ করে। হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীদের জন্য এমনই পরিপাটি থাকা পছন্দ করি, যেমন আমি তাদের ক্ষেত্রে সাজগোজ করে থাকতে পছন্দ করি।’ বায়হাকি : ১৪৭২৮
ঘরের কাজে সহযোগিতা : হজরত আসওয়াদ (রহ.) বলেন, আমি হজরত আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবী কারিম (সা.) ঘরে থাকা অবস্থায় কী করতেন? তিনি বললেন, ‘ঘরের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিজনের সহায়তা করতেন। আর নামাজের সময় নামাজে চলে যেতেন।’ সহিহ বোখারি: ৬৭৬
স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ : অধিকাংশ পরিবারে স্ত্রীরা সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও স্বামীর মন পায় না। সামান্য ত্রুটি চোখে পড়লেই স্বামীরা কথা শোনায়। এটা চরম অন্যায় ও জুলুম। হজরত রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই ভালো যে তার পরিবারের কাছে ভালো। আর আমি আমার পরিবারের কাছে তোমাদের চেয়ে উত্তম। জামে তিরমিজি : ৩৮৯৫
এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তানাদিদের নিয়ে সফরে যাওয়া, স্ত্রীর জন্য সামর্থ্যানুযায়ী ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা, স্ত্রীকে সুন্দর নামে ডাকা এবং কোনো অবস্থাতেই স্ত্রীকে প্রহার না করা। স্ত্রীদের মারধর করা চরম অন্যায়, এটা নিম্ন মানসিকতার পরিচয়।
ভয়েস/আআ/দেশরূপান্তর
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.