মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মানুষের জীবন নিত্য পরিবর্তনশীল। সুখ-দুঃখ, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সুস্থতা-অসুস্থতা, সফলতা-ব্যর্থতা ইত্যাদি নানা অবস্থা নিয়েই জীবন। এই নানা রূপ-অবস্থার মধ্য দিয়েই জীবন এগিয়ে চলে এবং সময় ফুরোতে থাকে। জীবনের অনভিপ্রেত অনাকাক্সিক্ষত অবস্থাগুলোকে জীবন থেকে বিয়োগ করা যায় না। এগুলো জীবনেরই অংশ। এই অবস্থাগুলোও কি মহিমান্বিত ও কল্যাণপূর্ণ হতে পারে? এমন কোনো উপায় কি আছে, যার দ্বারা জীবনের এই অংশটিও ইতিবাচক হতে পারে? সঞ্চয়ের খাতায় কিছু যোগ করতে পারে?
হ্যাঁ, অবশ্যই সেই উপায় আছে এবং তা মুমিনের জন্য। শুধু কর্ম নয়, মুমিনের জীবনের সব অবস্থা হতে পারে কল্যাণময়। অবস্থা বলতে জীবনের ওইসব অনুষঙ্গ, যা সরাসরি কর্ম নয়, তবে এর সঙ্গে রয়েছে বিশ্বাস ও কর্মের সংযোগ। যেমন সুখ-দুঃখ, সুস্থতা-অসুস্থতা ইত্যাদি। এসব অবস্থা কল্যাণময় হয়ে উঠতে পারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং যথার্থ বিশ্বাস ও কর্মের দ্বারা। সাহাবি হজরত সুহায়ব (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। সব কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। তারা সুখ-শান্তি লাভ করলে কৃতজ্ঞতা আদায় করে আর অসচ্ছলতা কিংবা দুঃখ-মুসিবতে আক্রান্ত হলে ধৈর্য ধারণ করে, প্রত্যেকটাই তার জন্য কল্যাণকর।’ -সহিহ মুসলিম : ২৯৯৯
ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের যে শিক্ষা ইসলাম দান করেছে, তার এক গভীর তাৎপর্য ও সুফল এই হাদিস থেকে পাওয়া যাচ্ছে। বর্ণিত হাদিসের স্পষ্ট বার্তা কোনো মানুষের জীবনই অর্থহীন নয়। যে মানুষকে দয়াময় আল্লাহ সর্বোত্তম দৈহিক ও মানসিক গঠনে তৈরি করেছেন তার জীবন অর্থহীন হতে পারে না, যদি সে তার সৃষ্টিকর্তার পরিচয় লাভ করে এবং তার আদেশ মান্য করে।
বর্ণিত হাদিসের আলোকে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, মুমিনের প্রাপ্তি ও কল্যাণ দ্বিগুণ। এটা স্বয়ং নবী কারিম (সা.) জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং হাসি-আনন্দ ও দুঃখ-কষ্ট সর্বাবস্থায়ই সে তার কর্মকাণ্ডের সুফল ভোগ করবে। এর ফলে তার জীবনে আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হবে, দূর হবে দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, হৃদয়ের সংকীর্ণতা ও জীবনের দুঃখ-কষ্ট এবং ইহজগতে তার জীবন হয়ে উঠবে অর্থবহ ও সুখময়।
এর বিপরীত চরিত্রের লোকেরা অপকর্ম, দাম্ভিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতা দ্বারা অপরাধপ্রবণ হবে। ফলে তার নৈতিকতা বিনষ্ট হয় এবং অধৈর্য ও অতি লোভের কারণে তার নৈতিক চরিত্র পশুর চরিত্রের মতো গড়ে উঠবে। এছাড়াও সে মানসিকভাবে হবে ভীষণ অশান্ত ও অস্থির। তার এই অস্থিরতার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে, যেমন প্রিয় কিছু হারানোর আশঙ্কা, নতুন নতুন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভয়। আরও একটি কারণ হচ্ছে- নফসের অস্থিরতা, যা কিছু অর্জন করুক আর না করুক- সার্বক্ষণিক সে আরও কিছু পেতে উদগ্রীব থাকবে। সে যদি নির্ধারিত অংশ পেয়েও যায়, তবুও সে উল্লিখিত কারণে (নতুন নতুন পেতে) অস্থির হয়ে উঠবে। এসব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক ও অসন্তুষ্টির কারণে সে দুঃখ-কষ্ট অনুভব করবে।
মুমিন যখন অসুস্থতা, দারিদ্র্য অথবা অনুরূপ কোনো মান-সম্মান বিনষ্টকারী বিপদ-মুসিবত দ্বারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তখন তার ইমান ও আল্লাহপ্রদত্ত রিজিকের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার কারণে তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝলক দেখা যায়। সে এমন কিছু প্রত্যাশা করে না, যা তার ভাগ্যে নেই। এ অবস্থায় সে তার চেয়ে খারাপ অবস্থাশালী ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে সান্ত¡না অনুভব করে। কোনো কোনো সময় তার আনন্দ-ফুর্তি ও মনের প্রফুল্লতা আরও বাড়ে ওই ব্যক্তির অবস্থা দেখে, যে ব্যক্তি দুনিয়ার সব উদ্দেশ্য হাসিল করেও পরিতৃপ্ত হতে পারেনি।
অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির কাছে ইমানের দাবি অনুযায়ী আমল নেই, তাকে যখন অভাব-অনটন দ্বারা, দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়ার কিছু থেকে বঞ্চিত করার দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা হয়, তখন তাকে আপনি দুঃখ-কষ্টে চরম বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পাবেন। আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো- যখন ভয় ও আতঙ্কের কারণসমূহ প্রকাশ পায় এবং মানুষ নানা অসুবিধা দ্বারা কষ্ট অনুভব করে, তখন তার মধ্যে বিশুদ্ধ ইমান, দৃঢ় মনোবল, মানসিক প্রশান্তি এবং উদ্ভূত এই সংকট মোকাবিলায় চিন্তায়, কথায় ও কাজে সামর্থ্যবান হওয়ার মতো গুণাবলি বিদ্যমান থাকে, তবে সে নিজেকে এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এই পরিস্থিতি মানুষকে আনন্দ দেয় এবং তার হৃদয়কে মজবুত করে।
অনুরূপভাবে আপনি ইমানহারা ব্যক্তিকে পাবেন সম্পূর্ণ বিপরীত। যখন সে ভয় ও আতঙ্কের অবস্থায় পতিত হবে, তখন তার হৃদয় অস্বস্তি অনুভব করবে; স্নায়ুতন্ত্রগুলো দুশ্চিন্তায় উত্তেজিত হয়ে উঠবে; তার মধ্যে বিরাজ করবে বাহ্যিক আতঙ্ক ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা। ফলে তার বাস্তব অবস্থা উদঘাটন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এ শ্রেণির মানুষের যদি স্বভাবগত উদ্দেশ্য হাসিল না হয়, যা অর্জনে অনেক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন; তবে তাদের শক্তি-সামর্থ্য ভেঙে পড়বে এবং স্নায়ুতন্ত্রগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠবে। আর এরূপ হবে ইমানের ঘাটতির কারণে, যা ধৈর্যধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে সংকটকালে ও দুঃখ-দুর্দশার সময়ে।
সুতরাং পুণ্যবান ও পাপী, মুমিন ও কাফের উভয়ে অর্জনীয় বীরত্ব অর্জনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মুমিন ব্যতিক্রম তার ইমানি শক্তি, ধৈর্য, আল্লাহর ওপর ভরসা এবং সওয়াবের প্রত্যাশার কারণে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা যন্ত্রণা পাও, তবে তারাও তো তোমাদের মতোই যন্ত্রণা পায় এবং আল্লাহর কাছে তোমরা যা আশা করো, তারা তা আশা করে না।’ -সুরা আন নিসা : ১০৪
আর তারা আল্লাহর বিশেষ সাহায্য লাভ করে এবং তার সাহায্য সব ধরনের ভয়-ভীতিকে ওলট-পালট করে দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ -সুরা আল আনফাল : ৪৬
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
muftianaet@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.