মো. তানজিমুল ইসলাম:
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম একটি জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অর্থনীতিতে জর্জরিত এই দেশে ১৯৭১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ, ১৯৭৪ সালে সাক্ষরতার হার দাঁড়ায় ২৫.৯ শতাংশ। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে সেই হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৫.৩ শতাংশ ও ৪৭.৯ শতাংশ এবং বর্তমানে এই হার প্রায় ৭৫ শতাংশ। তার মানে, ক্রমান্বয়ে এই হার খুব সন্তোষজনকভাবে বেড়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, দেশ অনেকখানি এগিয়েছে বা এগিয়ে চলেছে! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতি বছর এত এত শিক্ষিতের হার বেড়ে আসলে কী লাভ? জাতীয় উন্নয়নে আদৌ কি কোনো প্রভাব ফেলছে?
যে দেশে এত এত শিক্ষিত মানুষের বসবাস সে দেশে কেন এত অমানবিক, অপ্রত্যাশিত ঘটনা জন্ম দেয়? পক্ষান্তরে,অনেক বিখ্যাত মানুষের জ্বলন্ত উদাহরণ রয়েছে, যারা জীবনে কোনোদিনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি, কিন্তু বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী হিসেবে সমাজে সমাদৃত হয়েছেন, মৃত্যুর পরেও গণমানুষের মণিকোঠায় সম্মানের পাত্র হিসেবে বিশেষ অবস্থান করে নিয়েছেন। তবে কি আমরা বলতে পারি, স্বশিক্ষাই আসলে এর মূল কথা! শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ডিগ্রি অর্জন করলেই যে একজন মানুষের ভেতরের ভালো ভাবনাগুলো জাগ্রত হবে, সেটা মোটেই ঠিক নয়। প্রতি বছর অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী কৃতিত্বের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভারী ভারী ডিগ্রি অর্জন করছে! প্রায় প্রতিটি পরিবারেই নিদেনপক্ষে অল্পশিক্ষিত মা-বাবার সন্তানরাও অনেক ভালো রেজাল্ট নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সনদ অর্জন করছে! যেটি শুনতে বা বলতে বেশ ভালো লাগে! এজন্য আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়লেও আদৌ কি খুব লাভ হচ্ছে?
পৃথিবীর অনেক দেশের শিক্ষার হার বাংলাদেশের চেয়েও কম সত্ত্বেও জাতীয় অর্থনীতিতে তারা অনেক এগিয়ে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার শিক্ষার হার যেখানে শতকরা ৬৫ ও ৪০ ভাগ সেখানে বাংলাদেশে শিক্ষার হার বর্তমানে প্রায় ৭৫ ভাগ! শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ফলাফলের দিকে তাকালে আমাদের কেবল তৃপ্তির ঢেঁকুরই গিলতে হবে! বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় এ দেশে কেবল বেকারত্বের হারই বাড়ছে। সরকারের পক্ষে এই বিশালসংখ্যক শিক্ষিত ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
শিক্ষিতদের মধ্য থেকে প্রকৃত সৃজনশীল প্রতিভাধর মানুষ তৈরি হচ্ছে খুব কম! সীমিত সম্পদ আর সীমাহীন দুর্ভোগকে সঙ্গে নিয়ে তারা দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছে। জীবনে অর্জিত শিক্ষা যেন মূল্যহীন হয়ে পড়ছে, এমনি করেই সৃজনশীলতা ও উন্মুক্ত চিন্তার প্রায়োগিক কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে না। কোনো এক সময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত এই শ্রেণিটি অর্থ-বিত্তশালী, ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে! শিক্ষিত মানুষদের আর কোনো অহমবোধও থাকবে না এক সময়! শিক্ষা যদি জাতির মেরুদ-ই হয়ে থাকে, তবে তাকে নিয়ে আর অবহেলা করার অবকাশ নেই। আমরা প্রত্যেকেই জানি, একটি জাতি শিক্ষায় যত উন্নত, সে জাতির উন্নতির মাত্রাও তত বেশি! দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস না করে, তাদের সঠিকভাবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থাকে বিদায় দেওয়ার সময় এসে গেছে! জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে প্রায়োগিক শিক্ষার প্রসারতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি! এক্ষেত্রে শিক্ষকদের পাশাপাশি পিতামাতা ও নাগরিক সমাজ ও সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে শিক্ষিত সমাজকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে প্রয়োজন একটি সম্মিলিত প্রয়াস।
উন্নয়নশীল এই দেশে যে যেভাবে পারছে, অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত সবাই! বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মতো স্বনামধন্য শিক্ষকম-লিও বসে নেই এই প্রতিযোগিতায়! প্রায় প্রতি বছরই নতুন নতুন সিলেবাস প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে একটি অহেতুক আতঙ্কজনক পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে! ফলে প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্যের প্রসারতা বাড়ছে হু হু করে! দিনের পরে দিন সরকারি স্কুলগুলোতে নানান অজুহাতে ছুটি থাকলেও দুরন্ত গতিতে চলছে প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারগুলো! শিশু সুরক্ষা, শিশু নিরাপত্তার বিষয়টিকে তোয়াক্কা না করেই প্রচ- গরমে ছোট্ট একটি ঘরে মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার নামে রীতিমতো শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এমন জঘন্য প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা গোল্ডেন এ প্লাস পেলেও
প্রকৃতপক্ষে সৃজনশীল নাগরিক হতে ব্যর্থ হয়! উন্নয়নের অংশ হিসেবে ডিজিটাল প্রযুক্তির যত প্রসার ঘটছে, বৈষম্যও যেন বাড়ছে তত! চাহিদার তুলনায় শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতের হার বাড়ার ফলে, এদেশে যেমন বেকারত্বের হার বেড়েছে, অন্যদিকে অনিয়ন্ত্রিত বাজারনীতির ফলে বেড়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি! যা একটি ভয়ংকর বিষয়! বর্তমানে এ দেশের দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা বিপাকে পড়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বর্তমানে বেশির ভাগ মানুষই চিন্তিত! এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবিকার সংকট। এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিতের হার না বাড়িয়ে বরং দক্ষ শ্রমিক ও প্রায়োগিক শিক্ষার প্রসারতা বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। কর্মসংস্থানের গতি কমে যাওয়ার কারণে অর্থনীতিতে জীবিকার সংকট তৈরি হচ্ছে। শ্রমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। গবেষণা মতে, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৬ থেকে ২৭ লাখ লোক নতুন করে শ্রমের বাজারে আসে। এই হিসাবে গত দুই বছরে এসেছে ৫২ থেকে ৫৪ লাখ লোক। এদের বেশির ভাগেরই কর্মসংস্থান হয়নি। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছিল ২০১৭ সালে। ঐ জরিপ অনুযায়ী মোট শ্রমশক্তির মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ। বাকি ২৭ লাখ বেকার। ২০২৩ সালেও কর্মসংস্থান করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মোট কর্মসংস্থানে সরকারি চাকরিতে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে দেখা যায়, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ, আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশ। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী ১০ বছরে কোন শিল্প খাতে কেমন কর্মী দরকার হবে এবং কী ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন পড়বে এই প্রজেকশন না থাকলে, শিল্প খাতের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেক গ্র্যাজুয়েট তৈরি হবে, কিন্তু চাহিদামতো কর্মী তৈরি করা সম্ভব হবে না। আর তাই আপনাদের কাছে প্রশ্ন শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার বাড়লেই কি দেশ এগিয়ে যাবে? নাকি সুশিক্ষা ও স্বশিক্ষার প্রসার ঘটানোর সময় এক্ষুনি!
লেখক : কো-অর্ডিনেটর, ওয়ার্ল্ড ভিশন
aronnyk@gmail.com
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.