মোহাম্মদ অংকন:
বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, এখন মোটামুটি সবকিছুতেই তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া। বিগত সময়ের তুলনায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক কাজের চাহিদা, ধরন ও ক্ষেত্র। এখন সরকারি, বেসরকারিসহ সবধরনের প্রতিষ্ঠানেই আছে নিজস্ব ওয়েবসাইট, এমনকি ব্যক্তিপর্যায়েও ওয়েবসাইট ব্যবহার করাসহ ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষ ‘কানেক্টেড’ হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়নের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে যে কথাটি বেশ জোরালোভাবে কানে আসছে, তা হচ্ছে বড় ধরনের সাইবার হামলার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ।
২০২১ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান সাইবার হামলার শিকার হয়েছিল। উক্ত সাইবার হামলা চালিয়েছিল ‘হাফনিয়াম’ নামের একটি হ্যাকার গ্রুপ। ই-মেইলের মাধ্যমে হামলাটি পরিচালনা করা হয়েছিল। নেটওয়ার্ক অপারেটিং সিস্টেম থেকে মনিটর করার সময় হামলার বিষয়টি শনাক্ত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে হুমকির পেছনে লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে তাদের বটনেট ছড়িয়ে দেওয়া। এই বটনেট প্রক্রিয়ায় ইন্টারনেটে ম্যালওয়্যার ছড়িয়ে দিয়ে অন্যের কম্পিউটারে ঢুকে তথ্য চুরি ও অন্যান্য হামলা চালানো হয়। এতে তথ্য চুরি ও আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়। এর আওতায় হামলাকারীরা বাংলাদেশ সরকারের কভিড-১৯ এর টিকা দিতে নিবন্ধনের জন্য যে ওয়েবসাইট রয়েছে, সেটির আদলে ভুয়া ওয়েবসাইট বানিয়ে মানুষকে আকর্ষণ বা ফিশিংয়ের চেষ্টা করে। করোনা-মধ্যবর্তী সময়ে এটি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে সে সময় শক্ত কোনো অবস্থান নেওয়া হয়েছিল?
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সার্ভার থেকে তথ্য ফাঁস হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এক বিবৃতিতে উক্ত প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি জানান, ‘নির্দেশনা না মানা এবং টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে এমনটা ঘটেছে। হ্যাক নয়, সিস্টেম দুর্বলতার কারণে একটি সরকারি ওয়েবসাইটে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য উন্মোচন হয়েছিল।’ (সূত্র : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা)।
দেশে সাইবার হামলা ও তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটার মধ্যদিয়ে যে বিষয়টি তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কাছে শঙ্কার সৃষ্টি করছে, তা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত জনবল কাঠামো কতটা দক্ষ? আসলেই কি সেসব প্রতিষ্ঠান তথ্য ফাঁস সংক্রান্ত ঝুঁকি বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকে? সাইবার হামলা হলে তারা প্রতিরোধ করার সক্ষমতা রাখে কি? সাইবার সুরক্ষার বিষয়ে কতটা সচেতন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা? যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট বা ডেটা সার্ভার সুরক্ষার বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া অতি জরুরি। এজন্য কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মনিটরিং সেল গঠন করে বাৎসরিক প্রযুক্তিবিষয়ক অডিট করতে হবে, প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরতদের তথ্য সুরক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, ‘ডেটা সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সেইসঙ্গে এটা নিশ্চিত করতে হবে প্রতিষ্ঠানের এইসব টেকনিক্যাল কাজে নিয়োজিত জনবল কতটা টেকনিক্যাল।
আমাদের দেশে যখন তথ্য ফাঁস ও সাইবার হামলার ঘটনা ঘটে, তখন এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও বিশেষ কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। ফলে গোড়াতেই গলদ থেকে যায়। আর সেই গলদটা হচ্ছে, নন-টেকনিক্যাল জনবল দিয়ে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো মেইনটেনেন্স করানো। দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এদেশে বহু কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক রয়েছেন, যাদের মূল্যায়ন করা হয় না।
দেশকে সাইবার সন্ত্রাসমুক্ত করার বিষয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে। যে তথ্য আমাদের শক্তি, তা যদি বেনামে অন্যের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যায়, তবে দেশ মুহূর্তেই কতটা ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে, তা কল্পনারও বাইরে। দেশের নাগরিকদের যতসব তথ্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত আছে, তা যদি ফাঁসের মাধ্যমে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে এবং সার্ভারে থাকা স্বাক্ষর, আঙুলের ছাপ, চোখের ছাপ ইত্যাদি নিয়ে ব্যাংকসমূহ থেকে অর্থপাচার করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, তবে একইসঙ্গে দেশ মারাত্মক তথ্য সংরক্ষণ ঝুঁকিতে পড়বে ও বিপুল অর্থপাচার হবে। একইসঙ্গে অনলাইন কেনাকাটায় গ্রাহকরা প্রতারিত হবেন, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির মুখোমুখি হবেন, ব্ল্যাকমেইলের শিকার হবেন। সর্বোপরি নাগরিক সেবায় চরম জালিয়াতির মাধ্যমে বেআইনি কার্যক্রম শুরু হতে পারে। তাই তথ্য ফাঁস ও সাইবার হামলা থেকে দেশকে নিরাপদ রাখতে এবং তথ্যপ্রযুক্তিনখাতকে আরও গ্রহণযোগ্য করতে নন-টেকনিক্যালদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করার বিষয়ে এখনই সচেতন থাকতে হবে। সেইসঙ্গে টেকনিক্যালদের কাজে লাগাতে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রত্যাশা করব, বাংলাদেশকে তথ্য ফাঁস ও সাইবার সন্ত্রাসমুক্ত রাখতে সংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত প্রয়াস থাকবে যার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।
লেখক : প্রকৌশলী
angkon.co.dmp@gmail.com
ভয়েস/আআ/দেশরূপান্তর
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.