নাহিদ হাসান:
১
কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন ‘আমরা এমন একটা পঙ্গু সমাজে বসবাস করছি যেখানে ভালো মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারছে না, রাজনীতি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে,... আমাদের পূর্বসূরিরা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কোনো ক্ষমতাধর দৈত্য নয়।’
নির্বাচন সামনে। ধরা যাক, বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের আমলের মতো অবাধ নির্বাচন হলো। কিন্তু দেখা গিয়েছিল সেবারও প্রধান দুই জোটই প্রার্থী মনোনয়নের বেলায় টাকাওয়ালাদেরই তো মনোনয়ন দিয়েছে। অর্থাৎ মনোনয়ন বাণিজ্য ঠেকানো যায়নি। ফলত, প্রশ্ন জাগে যে, কোনো জায়গা থেকে আমাদের শুরু করতে হবে?
বলা হয়, এ দেশের জনগণ নির্বাচন নিয়ে আন্দোলন করেছে সবচেয়ে বেশি, কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে সবচেয়ে কম। অথচ নির্বাচনী ব্যবস্থা যেমন হবে, তার ওপরই নির্ভর করে কেমন প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। গত ১৯ ডিসেম্বর বিএনপি বহুল কাক্সিক্ষত রাষ্ট্র মেরামতের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সেখানেও নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে কথা নেই, আছে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের কথা।
২
এ দেশে ব্রিটিশরা প্রথম নির্বাচনের আইন করে ১৮৮২ সালে। তা ছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য। সরকার পরিচালনায় ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি ওঠে ১৮৮৫তে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সম্মেলনে। ১৮৯২ সালে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট’ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আইনসভায় ভারতীয়দের নির্বাচিত প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। নির্বাচন বলতে পরোক্ষ নির্বাচনকেই বোঝানো হতো।
মুসলিমদের আলাদা নির্বাচনের দাবিতে আইনটি সংশোধন হয় ১৯০৯ সালে। ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে লক্ষেèৗ চুক্তি হয়। তার ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ১৯১৯ সালে কেন্দ্রে দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা চালু হয়। ১৯২০ সালের হিসাব অনুযায়ী গোটা ভারতে ‘কাউন্সিল অব স্টেট’-এর ভোটার ছিল মাত্র ১৭ হাজার ৩৬৪ জন আর ‘সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ এসেম্বলির’ ছিল মাত্র ৯ লাখ ৯ হাজার ৮৭৪ জন। সম্পদশালী, শিক্ষিত, সরকারি খেতাবপ্রাপ্ত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানরাই ছিল ভোটার। তাদের ভোটেই উভয়কক্ষে প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো। এইটুকুতে সন্তুষ্ট ছিলাম না।
আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পুনরায় ১৯৩৫ সালে অ্যাক্টটির সংশোধন হয়। প্রদেশগুলোর জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টিত হয়। সম্প্রদায়ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে। এই আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালে ও ১৯৪৬ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে এবারও ভোটার ছিল মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ। আইনসভার মেয়াদ ছিল ৫ বছর। তবে গভর্নর জেনারেলের ইচ্ছাতে মেয়াদের আগে বিলুপ্ত বা মেয়াদের পরেও অব্যাহত থাকতে পারত।
এলো পাকিস্তান। প্রতি ১০ লাখ জনগণের একজন প্রতিনিধি হিসেবে মোট ৬৯ জনের পাকিস্তান গণপরিষদ গঠিত হয়। এর ৪৪ জনই ছিল পূর্ববাংলার। পরে করদরাজ্যগুলো এবং ভারত থেকে আসা বিপুল মোহাজের পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়ায় গণপরিষদ সদস্য বাড়িয়ে ৭৯ জন করা হয়। আইন অনুয়ায়ী ১৯৫১ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানে হয় ১৯৫৩ সালে এবং পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন হয় ১৯৫৪ সালে। পশ্চিম পাকিস্তানে জালিয়াতির নির্বাচন হয়।
১৯৫৪ সালে গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি বিল ২৯-১১ ভোটে পাস হয়। কিন্তু বাস্তবায়নের পূর্বেই ২৪ অক্টোবর তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট গণপরিষদ ভেঙে দেন। পরে ফেডারেল কোর্টের আদেশে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠিত হয়। এই দ্বিতীয় গণপরিষদ ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংবিধান গ্রহণ করে। এবং ২৩ মার্চকে সংবিধান প্রবর্তন দিবস ঘোষণা করে। পাকিস্তানকে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। হয় মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার। পূর্ব ও পশ্চিম থেকে উভয় সংখ্যক সদস্যকে নিয়ে ৩০০ সদস্যের জাতীয় পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়। ১০টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। ২১ বছর বয়সী সব নাগরিকের সরাসরি ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়।
নির্বাচন পরিচালনা, ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং অন্যান্য নির্বাচনী তত্ত্বাবধায়ক পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির পরামর্শে প্রেসিডেন্ট একজনকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ হিসেবে নিয়োগের বিধান করা হয়। কমিশনের মেয়াদ ছিল ৩ বছর। কিন্তু মীর্জা ইস্কান্দার ও আইয়ুব খান ক্ষমতা নিয়ে একটি কমিশন বানান। কমিশন রিপোর্ট করে, পাকিস্তানের জনগণ রাষ্ট্রপতি কিংবা জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচনের যোগ্যতাসম্পন্ন নয়। চালু করেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’। এই ব্যবস্থায় ৮০ হাজার সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতেন এবং ওই নির্বাচিত সদস্যরা রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় ও স্থানীয় পরিষদের নির্বাচন করতেন।
আইয়ুবের পতনের পর ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতি। নির্বাচনের জন্য তিনি ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ জারি করেন। বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও অধিকাংশ দল নির্বাচনে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ ৬ দফা ঘোষণা করে, যা দলটির জনসমর্থনের ভিত্তি তৈরি করে।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুন সংবিধান গ্রহণ করা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় গণপরিষদ। ঘোষণা করা হয় প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের। বর্তমানে যত ধরনের নির্বাচনী সমস্যা মোকাবিলা করি, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গণআন্দোলনের মুখে এরশাদশাহির পতন ঘটার আগ পর্যন্ত তাই চলে।
স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো ক্ষমতাসীন সরকারই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভালোভাবে, অর্থাৎ ভদ্রভাবে বিদায় নেয়নি। কারণ, নির্বাচন কমিশন নয়, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী-ই নির্ধারণ করে নির্বাচনের পরিবেশ। তাই আন্দোলনকারী সব শক্তির মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে বোঝাপড়া হচ্ছিল না। কিন্তু শেষে সবকিছু ছাপিয়ে যায় ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্ন।’ যা এরশাদ পতনের আগে শুরু হয়ে ’৯৬ সালে এসে একটা চেহারা পায়।
তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। বিএনপি ও আওয়ামী জোট দুবার করে ক্ষমতায় আসে। তারপর ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়। এবং বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ফিরে যায় ’৯০ পূর্ববর্তীকালে।
৩
বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ প্রস্তাবে বলেছে, ‘একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করার লক্ষ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন সংশোধন করা হবে। ইভিএম নয়, সব ভোটকেন্দ্রে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ আইন এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করা হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা হবে।’ এখানে প্রত্যেকটি ভোটের মূল্যায়ন হবে এমন ব্যবস্থা কই? একটি নির্দিষ্ট আসনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ১টি ভোট বেশি পেলেই বিজয়ী হন। রেকর্ড বলছে, ৩০-৪০ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তরা সরকার গঠন করে আর বাকি ৬০-৭০ ভাগ ভোটার প্রতিনিধিত্বহীন থাকেন। গঠিত হয় সংখ্যালঘিষ্ঠের সরকার। কিন্তু প্রচার হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সরকার হয়েছে।
প্রাপ্ত ভোটের ১ শতাংশ যে দল পাবেন, সেই দলও ৩টি আসনে জয়ী বলে বিবেচিত হলে বাকি ভোটের মূল্যায়ন হতো। এ জন্য প্রত্যেক দলকে নির্বাচনের পূর্বে এ ধরনের আসনের জন্য প্রার্থী ঘোষণা করতে হবে। তখন দলগুলো পরীক্ষিত নেতাদের মনোনয়ন দিতে বাধ্য থাকত। দল ৫১ শতাংশ ভোট না পেলে সরকার গঠন করতে পারবে না।
একটি ভোট বেশি পেলেই নির্বাচিত হওয়া যায় যখন, ফলে প্রতিটি আসনে মাফিয়া সর্দারই দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নিবেদিত সৎ নেতার চেয়ে যোগ্য। অথচ বিজয়ী প্রার্থীর ৫১ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তি বাধ্যতামূলক হলে প্রার্থীরা টাকা ও মাস্তানির খেলায় নামত না। যেখানে সর্বোচ্চ ভোট ৫১ শতাংশ হবে না, সেখানে শুধু সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত দুই প্রার্থীর মধ্যে পুনরায় নির্বাচন হবে। তখন ক্ষমতার দৈত্যদের সংসদ দখলের সুযোগ কঠিন হবে। এই নির্বাচনী ব্যবস্থা ছাড়া পূর্বসূরিরা যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চেয়েছিলেন তা কেমনে হবে?
লেখক: লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge1@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.