মযহারুল ইসলাম বাবলা:
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ দল দুটি ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে জন্মলাভ করেছিল। কংগ্রেস দলে মুসলিমদের অংশগ্রহণ থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিক্য, কর্তৃত্ব এবং গুরুত্ব ছিল অধিক। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খান, ডা. আনসারী, সৈফুদ্দিন কিচলু, আসফ আলী প্রমুখ মুসলিম নেতারা কংগ্রেসে ছিলেন বটে, তবে কংগ্রেসের হিন্দুয়ানি চরিত্রের বদল করতে পারেননি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের কংগ্রেস দলে সম্পৃক্তির পেছনে অনগ্রসর মুসলিম সম্প্রদায়ের বিষয়টিও বিবেচনার দাবি রাখে। হিন্দু সম্প্রদায় অর্থ-বিত্তে, শিক্ষায়-সম্পদে ছিল অগ্রবর্তী। পাকিস্তান স্রষ্টা জিন্নাহও কংগ্রেসে ছিলেন। কংগ্রেসে থাকাবস্থায় তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেছিলেন। নেহরুদের দ্বারা ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে কংগ্রেস ত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষ জিন্নাহ জিগির তুলেছিলেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের পৃথক ভূমি। ব্যক্তিগত জীবনযাপনে সামগ্রিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ জিন্নাহ আচানক সাম্প্রদায়িক নেতারূপে আবির্ভূত হন। যার পেছনে সম্প্রদায়গত স্বার্থের চেয়েও অধিক ছিল ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে¡র স্বার্থ। মুসলিম লীগে তিনি একক কর্তৃত্ব সহজেই প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। মুসলিম লীগের একনায়ক ছিলেন জিন্নাহ। জিন্নাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে মুসলিম লীগের একটি সিদ্ধান্তও গৃহীত হওয়ার উপায় ছিল না। মুসলমানদের পৃথক ভূমির দাবি তুলে কংগ্রেসের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করে নিজেদের ইচ্ছা পূরণে জিন্নাহর ওপর দায় চাপিয়ে দেশভাগে নীরবে মদদ জুগিয়েছিল। অবশ্য সম্প্রদায় বিভাজনের দ্বন্দ্বের পেছনে ব্রিটিশদের ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন জড়িত ছিল। অন্যদিকে, কংগ্রেস নেতৃত্ব নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষরূপেও প্রমাণ দিতে পারেনি। স্বয়ং গান্ধী অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। চূড়ান্ত দুই প্রধান দলের ক্ষমতার ভাগাভাগিতে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল দেশভাগ।
পাঞ্জাব ও বাংলা খণ্ডিত হয়েছিল দেশভাগে। দুই প্রদেশের শীর্ষ রাজনীতিকদের দোষ ও ভুলের মাশুল দিয়েছিল দুই সম্প্রদায়ের অগণিত সাধারণ মানুষ। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবকে দেশভাগের জন্য অনেকটা দায়ী করা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি লাহোর প্রস্তাবের অনুসরণে ছিল। স্বায়ত্তশাসনের দাবি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কখনো আমলে নেয়নি। এমন কি আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের পরক্ষণে পূর্ব বাংলার ৯৮% স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূরণের নির্জলা মিথ্যাচার করতে দ্বিধা করেননি। যুদ্ধজোটের এবং ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে বিলম্ব করেননি। যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানী কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দীকে সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দীঘনিষ্ঠ শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর জীবদ্দশায় স্বায়ত্তশাসনের দাবি কখনো তুলতে পারেননি। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরই শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ছয় দফা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবেরই ধারাবাহিক। আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে মুক্তি লাভের পর স্বাধীনতার লক্ষ্যে গঠন করেছিলেন ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি’।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাংলায় কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ পরস্পরের প্রবল প্রতিপক্ষ এবং ছিল চরম শত্রুতুল্য। তাদের পক্ষে যৌথ সরকার গঠন ছিল অসম্ভব।
কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হক কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ সরকার গঠনের প্রস্তাবে প্রদেশ কংগ্রেস সম্মত হলেও, একমাত্র নেহরুর প্রবল বিরোধিতায় সে প্রস্তাব ভেস্তে যায়। নেহরুর সেই ভুল সিদ্ধান্তই বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ বপন হয়েছিল। ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অভিলাষে মুসলিম লীগের সঙ্গে যৌথ সরকার গঠন করে রাজনৈতিক পতন ডেকে এনেছিলেন। নিজের এবং দলের তো বটেই। পাশাপাশি মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ বাংলা প্রদেশে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ফজলুল হকের দোষ-ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে বাংলার উভয় সম্প্রদায়ের মানুষদের। শেষ জীবনে ফজলুল হক অকপটে বলেছেন, ‘আমার রাজনৈতিক জীবনে অনেক মিথ্যার ভ্রান্তি আছে। আত্মজীবনীতে সেই মিথ্যা ও ভ্রান্তি টেনে আনতে চাই না। মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় যে জীবনী বা ইতিহাস, তা ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হয়। ... আত্মজীবনী লেখার কাজে আমি তাই কিছু সময় নিচ্ছি। অকপটে সব সত্য কথা বলার সাহস সঞ্চয় করছি।’ কিন্তু তিনি আত্মজীবনী লিখে যেতে পারেননি।
দেশভাগে বাংলার ন্যায় পাঞ্জাবেরও অভিন্ন ভাগ্যবরণ করতে হয়েছিল। পাঞ্জাবের অসাম্প্রদায়িক ইউনিয়নিস্ট পার্টির প্রধান সিকান্দার হায়াত খান প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। যিনি মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবল বিরোধী ছিলেন। মোটেও পছন্দ করতেন না মুসলিম লীগ এবং দলটির একনায়ক জিন্নাহকে। আস্থা-দুর্বলতা কোনোটি ছিল না মুসলিম লীগ এবং জিন্নাহর প্রতি। অথচ শেষ পর্যন্ত চতুর জিন্নাহ অলৌকিক জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় তাকেও বগলদাবা করতে পেরেছিলেন। জিন্নাহর কাছে নিজেকে এবং অসাম্প্রদায়িক ইউনিয়নিস্ট পার্টিকে সঁপে দিয়ে পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। একদিকে মুসলিম সম্প্রদায়, অন্যদিকে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের মিলিত শক্তি পরস্পরের মুখোমুখি। একে অপরের চরম শত্রুরূপে প্রকাশ্যে রণ সাজে প্রস্তুত। চূড়ান্ত রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। পাঞ্জাবের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেশভাগের চরম ট্র্যাজেডিরূপে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। মর্র্মান্তিক সেই দাঙ্গায় অগণিত মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। বাংলার ফজলুল হক এবং পাঞ্জাবের সিকান্দার হায়াত খানের রাজনৈতিক দোষ-ভুলের মাশুল দিয়েছিল অখণ্ড পাঞ্জাবের দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। একমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বিনা অপরাধে অগণিত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সে দায় অভিযুক্ত রাজনীতিকদের বহন করতেই হবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
mibabla71@gmail.com
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.