মোস্তফা কামাল:
প্রতিপক্ষ দলের ষড়যন্ত্র করা লাগেনি বা প্ররোচনা দিতে হয়নি। নিজ থেকেই স্বামী সাভারের স্থানীয় বিএনপি নেতা ফরহাদ মিয়াকে তালাকের নোটিস দিয়েছেন স্ত্রী রহিমা বেগম। সাভার মডেল থানায় গিয়ে জিডি করে জানিয়েছেন, তিনি সাচ্চা আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। অথচ তার স্বামী ফরহাদ বিএনপি করেন। বিএনপির একটা মিছিলও বাদ দেন না। মিছিলে যেতে মানা করলে তাকে মারধরসহ নির্যাতন করেন। তাই এ স্বামীর সঙ্গে তিনি আর সংসার করবেন না। এর আগে ভুক্তভোগী রহিমা বেগম ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামানের কার্যালয়েও এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়েছেন।
পুলিশের জন্য এটি আচ্ছা রকমের উটকা ঝামেলা। কোন পক্ষ নেবে? জিডি বা মামলা পোক্ত করতে গেলে ঘটনার সঙ্গে তাদের আরও কিছু যোগ করতে হয়। সেই দৃষ্টে সাভার মডেল থানার ডিউটি অফিসার বলেছেন, তার স্বামী বিএনপি সমর্থকই নন, নেশাগ্রস্তও। নেশার টাকা না পেলে এই জাতীয়তাবাদী স্বামী তার আওয়ামী স্ত্রীকে মারধর করে। প্রায় ২০ বছরের ঘর-সংসার তাদের। বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে। দুটি সন্তানও হয়েছে। এত বছরে স্বামী-স্ত্রীর জাতীয়তাবাদ নিয়ে সমস্যা হয়নি। আওয়ামী-বিএনপি নিয়ে গোলমাল বাধেনি। সমস্যা হয়ে গেছে গত সপ্তাহে। রহিমার মতে, তার স্বামীর সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ, তিনি বিএনপি করেন। এই স্বামী এখন বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলে বা আওয়ামী লীগের মিছিলে গেলে ল্যাঠা মিটে যাবে কিনা সেই প্রশ্ন করা হয়নি। পুলিশও জানতে চায়নি। দুপক্ষের অভিভাবক বা স্থানীয়রা আলাপ-সংলাপের ব্যবস্থা করলে একটা রাজনৈতিক হিল্লা হয়ে যাওয়ার আশা থাকে।
রাজনীতির বাতাসে আমাদের সামাজিক চিত্রের একটি খণ্ড অংশ ঘটল সাভারে। এর আগে, ফেনীর প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার স্ত্রীকে নিয়ে বিএনপি নেতার চম্পট দেওয়া বা রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ নেতার বৌকে নিয়ে বিএনপি নেতার ভেগে যাওয়ার সংবাদের মধ্যে কারও কারও বিকৃত সুখবোধের বিষয় ছিল। আন্দোলনে টানা ব্যর্থতার মধ্যে একে ভিন্ন স্টাইলের প্রতিশোধ ভাবার লোকের অভাব হয়নি রঙ্গভরা এ দেশে। থানা-পুলিশ পর্যন্ত না গড়ালে এসব ঘটনা গণমাধ্যমে নাও আসতে পারত। সাভারেও তাই।
সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের কদাকার ঘটনা বাড়বাড়ন্ত। কোনো কোনোটি লেখার বা বলারও অযোগ্য। কিন্তু, সোশ্যাল মিডিয়া ছাড় দিচ্ছে না। সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁক গড়িয়ে চলে আসছে মূলধারার গণমাধ্যমেও। কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির দাতা সদস্য, রাজনীতিক, ধনবান খন্দকার মুশতাক আহমেদের ঘটনা বেশ ভাইরাল। তা থানা-পুলিশ গড়িয়ে হাইকোর্টেও চলে গেছে। মহান পেশা রাজনীতি আর পবিত্র জায়গা আদালত। সেখানেও সাবজেক্ট হয়ে যাচ্ছে এসব ঘটনা। কলেজছাত্রীকে প্রলোভন ও জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগে গত ১ আগস্ট রাজধানীর মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির দাতা সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। আর এতে সহযোগী হিসেবে কলেজের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীকে আসামি করা হয়। ভুক্তভোগী কলেজছাত্রীর বাবা মো. সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
মামলার এজহারে বাদী উল্লেখ করেন, তার মেয়ে মতিঝিল আইডিয়ালের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। আসামি মুশতাক বিভিন্ন অজুহাতে কলেজে আসতেন এবং ভিকটিমকে ক্লাস থেকে প্রিন্সিপালের কক্ষে ডেকে আনতেন। খোঁজখবর নেওয়ার নামে আসামি ভিকটিমকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করতেন। কয়েক দিন পর আসামি মুশতাক ভিকটিমকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কুপ্রস্তাব দেন। এতে রাজি না হওয়ায় ভুক্তভোগীকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক বিয়ে এবং তাকে ও তার পরিবারকে ঢাকাছাড়া করবেন বলে হুমকি দেন মুশতাক। এ বিষয়ে বাদী প্রতিকার চাইতে গেলেও কোনো সহযোগিতা করেননি অধ্যক্ষ; বরং আসামি মুশতাককে অনৈতিক সাহায্য করে আসতে থাকেন। এরপর বাদী জানতে পারেন আসামি ভিকটিমকে একেক দিন একেক স্থানে রেখে অনৈতিক কাজে বাধ্য করেছেন এবং যৌন নিপীড়ন করেছেন।
আদালতে হাজির হয়ে আগাম জামিনের আবেদন করেন খন্দকার মুশতাক। শুনানিতে হাইকোর্ট মুশতাককে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি বিবাহিত? জবাবে মুশতাক বলেন, ‘হ্যাঁ। তবে সেই সংসার অনেক আগেই ভেঙে গেছে।’ এ সময় হাইকোর্ট বলে, ছাত্রীকে বিয়ে করে নৈতিকভাবে কাজটি ঠিক করেননি। এ সময় তার আইনজীবী বলেন, এই মামলার অপর আসামিকে জামিন দিয়েছে অপর একটি বেঞ্চ। এ সময় আদালত বলে, ‘আমাদের বেঞ্চ এ জামিন শুনতে আগ্রহী নয়।’ পরে তার আইনজীবী আবেদন ফেরত দেওয়ার আবেদন করলে তা ফেরত দেয় হাইকোর্ট। অবশ্য ওই কলেজছাত্রী দাবি করেছে মুশতাক তাকে জোরপূর্বক আটকে রাখেননি, তাদের সম্পর্কটি নিখাদ প্রেমের সম্পর্ক।
শুনতে কেমন লাগে এসব ঘটনা? আদালতের শুনানিতে উঠে আসা বক্তব্যগুলো সহ্য করা কোনো সভ্য মানুষের কানের জন্য কতটা সহনীয়-শোভনীয়? একই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে যুব মহিলা লীগের এক নেত্রীর সঙ্গে এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার অন্তরঙ্গ নানান ছবি। ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যায়, এই নেতা ও নেত্রী তাদের কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে মদের আসর বসিয়েছেন। নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য এইচ এম ইব্রাহীম গণমাধ্যমকে বলেছেন, এরা সবাই তার লোক। তাই কিছু করতেও পারছেন না।
মানিকগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য, আলোচিত কণ্ঠশিল্পী মমতাজ মাঝেমধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় গণমাধ্যমের শিরোনামে আসছেন। এবার তাকে টেনে এনেছেন বর্তমান স্বামী ডা. এ এস এম মঈন হাসান। বছর খানেক আগে তার ওপর একবার হামলা হয়েছিল। এক বছর পর জানালেন হামলাকারীদের কারও কারও সঙ্গে তার স্ত্রীকে দেখা যায়। হামলার এক বছরেও বিচার না পেয়ে নিজের ফেসবুক আইডিতে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছেন এই এমপিপতি। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘কতটুকু অশ্রু গড়ালে হৃদয় জলে সিক্ত, কত প্রদীপ শিখা জ্বালাতেই জীবন আলোয় উদ্দীপ্ত, কত ব্যথা বুকে চাপালে তাকে বলি আমি ধৈর্য, নির্মমতা কতদূর হলে জাতি হবে নির্লজ্জ...’।
আপলোড করা ছবিতে তার ওপর ১ বছর আগে করা হামলার বেশ কয়েকটি ছবি ও থানায় দায়ের করা অভিযোগের কপি স্থান পায়। এর মধ্যে রয়েছে- হামলায় আহত হওয়া নিজের ছবি, ভাঙচুরকৃত গাড়ির ছবি ও এমপি মমতাজের সঙ্গে গোল চিহ্নিত হামলাকারী নয়নের ছবি। সেই সঙ্গে সম্প্রতি সিংগাইরে চাঞ্চল্যকর জেপি নেতা সালাম বাহাদুর হত্যার কিলার হিসেবেও নয়নের ছবি আপলোড করা হয়েছে। মমতাজ বেগমের স্বামী ডা. এ এস এম মঈন হাসান স্ট্যাটাসে আপলোড করা ছবিটির ক্যাপশনে লিখেছেন, হত্যার মতো ভয়ংকর অপরাধ করেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। মমতাজের স্বামীর এ স্ট্যাটাস নিয়ে মানিকগঞ্জের রাজনৈতিক মহলসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। এমপি মমতাজের সঙ্গে বর্তমান স্বামী ডা. মঈনের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এখন তারা এক ছাদের নিচে থাকছেন না। মমতাজ বেগমের বিভিন্ন পারিবারিক প্রোগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে তাকে অনুপস্থিত দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ এমপি মমতাজ টানা বেশ কয়েক দিন কানাডা ভ্রমণ করেছেন। সেখানে তার পরিবারের সদস্য ছাড়াও সফরসঙ্গী ছিলেন ব্যক্তিগত সহকারীও। সফরসঙ্গী তালিকায় ছিলেন না স্বামী ডা. মঈন হাসান।
এ সময়টাতেই দলীয় পদ পেতে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নির্যাতনের মাধ্যমে সন্তান নষ্ট করার অভিযোগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাহ ফরিদের বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসের ১৩ তারিখে রুবাইয়া রীতিকে বিয়ে করেন খালিদ সাইফুল্লাহ। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য রীতিকে নির্যাতন শুরু করেন সাইফুল্লাহ। এর মধ্যেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন রীতি। এ নিয়ে শুরু হয় সাংসারিক ঝামেলা। নতুন কমিটিতে আবারও সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী, এ কারণে বিয়ে করার সময় তাকে বিষয়টি গোপন রাখতে বলেন খালিদ। রীতি গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিয়ের দেড় মাস পর তিনি কনসিভ করেন। কিন্তু খালিদ তাকে জানান, বাচ্চার পরিচয় দিতে গেলে তার কমিটি থাকবে না। তিনি লাখ লাখ টাকা খরচ করে এই কমিটি পেয়েছেন। এখন এই বাচ্চার জন্য কমিটি ছাড়া যায়? ঘটনার পরদিন ভুক্তভোগী খিলগাঁও থানায় নারী নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার মামলা করলে ২৩ জুলাই খালিদ সাইফুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়। আশ্চর্যজনকভাবে এমন মামলায়ও আটকের পরদিনই জামিনে মুক্তি পান অভিযুক্ত খালিদ সাইফুল্লাহ।
ক্ষমতাসীন দলের নেত্রকোনার পূর্বধলা আসনের এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের অন্দরমহলের ঘটনা আরও আউলাঝাউলা। মধ্যরাতে তাকে তুলে নিয়ে তার যুবলীগ-ছাত্রলীগের সাঙ্গপাঙ্গরা নাদিয়া আক্তার নামের এক কলেজছাত্রীর সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। পূর্বধলা থানায় এ মর্মে মামলা করেছেন এই মাননীয়র স্ত্রী রওশন হোসেন। আসামি করেছেন এমপির নয়া স্ত্রী নাদীয়া, নতুন শ্যালক পূর্বধলা সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগ নেতা তাইফ, এমপির পিএস ফেরদৌস, গাড়িচালক শফিকসহ ৯ জনকে। পুলিশের জন্য যারপরনাই বিব্রতকর অবস্থা মামলাটি নিয়ে। ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল যেনতেন এমপি নন, অন্য উচ্চতার ব্যক্তি। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে খেতাবপ্রাপ্ত বীরপ্রতীক তিনি। আর ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার বহুল আলোচিত কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই।
উল্টাপাল্টার এসব উদাম দৌড় নিয়েই এগোচ্ছে বাংলাদেশের মাঠ তথা ঘর-সংসারের রাজনীতি। এর মধ্যে আমাদের কিছুটা আশা দেখাচ্ছে বিদেশিরা। এরা তরুণ-তরুণী, কূটনীতিক নন। ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশিরা কূটনীতিকরা দিচ্ছেন রাজনীতির পরিচ্ছন্নতার তাগাদা। আর বাংলাদেশের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে আসছেন এসব বিদেশি তরুণ-তরুণী। সংবাদমাধ্যমেও এসব ঘটনার কিছু কিছু আসছে চমকপ্রদ খবর হিসেবে। প্রেমের টানে ভিনদেশ থেকে এসে আমাদের ছেলে বা মেয়েদের তারা বিয়ে করছেন। উৎকট-দুর্গন্ধময় অতীত পেছনে ফেলে রুপালি পর্দার কাহিনির মতো কেউ এখানেই সংসার করছেন, কেউ বা নিয়ে যাচ্ছেন নিজ দেশে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
mostofa71@gmail.com
ভয়েস/আআ/দেশরূপান্তর
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.