মোরশেদুল আলম মহব্বত:
মানুষ হিসাবে আমাদের স্রোতের অনুকুলে যাওয়ার এক ধরনের প্রবণতা আছে। এটি এমনকি পিতা-মাতা হওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, বিশেষত বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে আমাদের চিন্তা আমাদের সমাজে সত্য বলে প্রচলিত স্টেরিওটিপিক্যাল ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমাদের বেশিরভাগই সন্তান নিতে চায় সমাজের অদৃশ্য চাপের কারনে। আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই আছে যারা পিতৃত্বের/মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে প্যারেন্টিং সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করে যেন সন্তানের জন্মের পরে তারা নিজেদের সর্বোচ্চ সন্তানের মঙ্গলের জন্য নিগড়ে দিতে পারেন।
ফলস্বরূপ, আমাদের বেশিরভাগই শিশুদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ব কি কি সেটা উপলব্ধি না করেই বাবা-মা হয়ে যায়। আমাদের সমাজে প্যারেন্টিং-সম্পর্কিত প্রচলিত বদ্ধমুল ধারনা এবং সঠিক উপলব্ধির অভাব প্রায়শই আমাদের এমন একটি অবস্থার দিকে নিয়ে যায় যেখানে আমরা আমাদের বাচ্চাদের যে অধিকারগুলো আমাদের কাছ থেকে প্রাপ্য সেগুলো নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, এমনকি আমরা সেসব অদৃশ্য অধিকার নিয়ে কথাও বলতে প্রস্তুত না, রক্ষা করা তো দূরের কথা।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমরা আমাদের বাচ্চাদের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য দুই ধরনের অধিকারই বিভিন্নভাবে লঙ্ঘন করি। কেউ কেউ অবশ্য সন্তানের অধিকারের এই পুরো বিষয়টিকেই হাস্যকর ভাবতে পারে। প্রথম যে অধিকারটি আমরা প্রায়শই নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হই তা হলো শিশুদের জন্য ঝগড়া-কলহ মুক্ত পারিবারিক পরিবেশ যেখানে একটি শিশু সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারবে। আমাদের সমাজে পারিবারিক কলহকে খুব স্বাভাবিক বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া অবশ্যই হতে পারে তবে সেটা সন্তানের সামনে নয়। সম্পর্কের মাঝে টানাপোড়ন ও মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই বাচ্চার মানসিক সুস্থতায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এমন পর্যায়ে করা যাবে না।
পিতামাতারা প্রায়ই তাদের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ধ্বংসাত্মক উপায় অবলম্বন করেন যা তাদের সন্তানকে হতাশ করে। খ্যাতিমান মনোবিজ্ঞানী কামিংস এবং প্যাট্রিক ডেভিস রচিত ‘মেরিটাল কনফ্লিক্ট অ্যান্ড চিলড্রেন: এ ইমোশনাল সিকিউরিটি পার্স্পেক্টিপ’ বইটিতে দাবি করা হয়েছে যে বাবা-মা একে অপরের সাথে মৌখিক আগ্রাসন, অপমান, হুমকির মতো ব্যবহার করেন এবং মাঝে মধ্যে এই তিক্ততা শারীরিক নির্যাতন পর্যায়ে চলে যায়। এমন ব্যবহার এবং উদ্যম আচরণ একটি শিশুর মানসিক বিকাশের উপর চরম প্রভাব ফেলতে পারে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ বাবা-মা এই বিষয়টি আমলে নেন না। তারা শিশুর সামনেই ঝগড়া করে এবং একজন সন্তানের বড় হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ পাওয়ার অধিকার লঙ্ঘন করে।
দ্বিতীয়ত, আমরা জীবনে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের অগ্রাধিকারও পরিবর্তিত হয়। আর তাই আমাদের মধ্যে অনেকেই ক্যারিয়ারে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি যে আমরা বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে ভুলে যায়। বাবাদের জন্য এটি বিশেষভাবে সত্য, কারণ তারা বেশিরভাগ পরিবারে অর্থ উপার্জনকারীর ভুমিকা পালন করে থাকে। ক্যারিয়ার নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখা অবশ্যই দোষের কিছু না, তবে তা যেন আমাদের পরিবার এবং সন্তানের অগ্রাধিকারের জায়গাটা না নিয়ে নেই।
আমাদের সমাজে অনেক পিতারই এই ধারণা আছে যে অর্থের জোগান দেওয়াই তার একমাত্র কাজ এবং তার বাচ্চার মৌলিক অধিকার পুরন করা পর্যন্তই তার দায়িত্ব সীমাবদ্ধ। এমন বাবারা তাদের সন্তানের প্রতি তাদের যে মানসিক ও আবেগ সংক্রান্ত দায়বদ্ধতা আছে সেটা বুঝতে চান না এবং অনেকে অগ্রাহ্যও করেন বটে। এই ধরনের ব্যবহার ও মানসিকতা একটি শিশুর মানসিক অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন, কারণ সে বাবার পাশাপাশি তার সময়েরও দাবিদার।
তৃতীয়ত, আমাদের সমাজে পিতামাতারা তাদের বাচ্চার স্বতন্ত্রবোধকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। শিক্ষা এবং ক্যারিয়ার সম্পর্কিত কিছু ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে সত্য। পিতামাতারা তাদের সন্তানকে তাদের সম্প্রসারিত রুপ হিসেবে বিবেচনা করার কারণে অনেক সময় নিজেদের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো বাচ্চাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবনতা কাজ করে।
ফলস্বরূপ, তারা চায় তাদের সন্তানরা সেই স্বপ্নগুলি পূরণ করবে যা তারা নিজেরাই তাদের জীবদ্দশায় কখনও অর্জন করতে পারেনি। আর তাই বেশিরভাগ পিতা-মাতা চান তাদের বাচ্চারা হয় একজন ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারি চাকুরীজীবি হবে কারণ তাদের বাবা-মাও তাদের কাছ থেকে একই ধরনের প্রত্যাশা রেখেছিলেন। এ জাতীয় কর্তৃত্ববাদী প্যারেন্টিং কেবল সন্তানের আত্মমর্যাদাকেই ক্ষতি করে না; বরং সন্তান ও পিতামাতার মধ্যে একটি মানসিক ব্যবধান তৈরি করে।
চতুর্থত, আমাদের দেশের অনেক পিতা-মাতাই তাদের বাচ্চার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা (বিশেষ করে মৌলিক অধিকারের) পালন করতে আগ্রহী না। অনেকেই শিশুদের খাদ্য, আশ্রয় এবং শিক্ষা পাওয়ার প্রাথমিক অধিকারকে অস্বীকার করে। রাস্তার ভাসমান বাচ্চাদের দিকে তাকালে এই বিষয়টি সহজেই অনুধাবন করা যায়। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন এনজিওর অনুমান অনুসারে, আমাদের দেশে প্রায় ১১ লক্ষ পথশিশু রয়েছে এবং তাদের বেশিরভাগই কোনও পরিবারের সমর্থন ছাড়াই জীবন-যাপন করছে। এবার একটু চিন্তা করুন - এই সব বাচ্চাদের বাবা-মা কোথায়? দায়িত্ব পালন না করার জন্য কি তারা কোনও সামাজিক চাপ বা শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছে?
মনে প্রশ্ন জাগে আমাদের দেশে শিশুদের অধিকার এত প্রকাশ্য ও নির্বিচারে লঙ্ঘন করা হয় কেন? গভীরভাবে লক্ষ্য করলে এর দুটি কারণ পাওয়া যাবে – সমাজে প্রচলিত প্যারেন্টিং-সম্পর্কিত বদ্ধমূল ধারণা এবং সোশ্যাল প্রোগ্রামিং। প্রথমত, আমাদের সমাজে পিতামাতাকে দেবতুল্য মনে করা হয়। এজন্য তাদের বাচ্চাদের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব রয়েছে তা পালন না করলেও তাদেরকে কোন ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না - কোনও দায়বদ্ধতার জায়গা নেই এই বিষয়ে। সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অন্ধভাবে বিশ্বাস করে যে বাবা-মায়েরা সন্তানদের জন্য যাই করুক না কেন তাতে তাদের মঙ্গলই হবে।
এমন বদ্ধমূল ধ্যান-ধারণাই এমন পরিস্থিতির জন্ম দেয় যেখানে সন্তানের অধিকার নিয়ে এবং সঠিক প্যারেন্টিং হচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে কথা বলা দুরহ। আর এ জন্য রাষ্ট্রও বাচ্চাদের পূর্ব-উল্লিখিত অদৃশ্য অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দেয় না। এ কারণেই পিতামাতাদের তাদের শিশুদের মানসিক নির্যাতন করা থেকে বিরত করার জন্য কোনও আইন নেই এবং কোনও বাবা-মাকে তাদের সন্তানের অধিকার না পূরণের জন্য কোনোদিন আইনের আওতায় আনা হয়নি।
অন্য কারণটি হলো সোশ্যাল কন্ডিশনিং। আমরা আমাদের শৈশবকাল থেকেই একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাট অনুসরণ করে চিন্তা করতে শিখি - এর মধ্যে একটি হ'ল এমন আচরণ করা বা প্রতিক্রিয়া জানানো যা সাধারণত সমাজ সমর্থন করে। এবং সমাজ আমাদের এমনভাবে ভাবতে শিখাই যে পিতামাতা যা করবে তাই ঠিক, ন্যয়সঙ্গত এবং উপকারী। এমন চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায় মিডিয়াতে। যখনই কোনও বৃদ্ধ বাবা-মাকে তার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে/মেয়ে কোথাও ফেলে রেখে যায়, গনমাধ্যম ঘটনাটিকে চাঞ্চল্যকরভাবে উপস্থাপন করে। এটা পুরোপুরি ঠিক আছে। কিন্তু আপনি কি কখনো কোনও মিডিয়া আউটলেটকে স্ট্রিট চিলড্রেনদের পিতামাতার উপর এমন সংবাদ করতে দেখেছেন? উত্তরটি অবশ্যই 'না' এবং এমনকি সাধারণ মানুষরাও ঐসব দায়িত্বজ্ঞানহীন পিতামাতাদের নিয়ে সমালোচনা থেকে বিরত থাকেন। কারণ ছোট বেলা থেকেই আমাদের সেভাবে চিন্তা করার জন্য সামাজিকভাবে প্রোগ্রাম করা হয়।
প্রশ্ন হলো এই সমস্ত অধিকার পূরণ না হলে কী হবে? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনোবিজ্ঞানী জিন পিয়াগেট বিকাশের চারটি ধাপের রূপরেখা দিয়েছেন- সেন্সরিমোটর পর্যায়, প্রি-অপারেশনাল পর্যায়, কংক্রিট অপারেশনাল পর্যায় এবং ফরমাল অপারেশন পর্যায়। এই সমস্ত পর্যায়ে একটি শিশু স্কিমার (এমন ধরনের জ্ঞান যা একটি শিশুকে যে কোন ধরনের ব্যাখ্যা বুঝতে সাহায্য করে) মাধ্যমে শিখতে পারে। যখন কোনও সন্তানের অধিকার অস্বীকার করা হয় এবং সহিংসতার মুখোমুখি হয়, তখন সেই শিশুর মধ্যে এই ধরনের স্কিমা তৈরি হয় এবং সম্পর্ক ও পারিবারিক জীবন নিয়ে তার মধ্যে বিদ্রুপ ধারণা বিকশিত হয়। যার ফলে সেই শিশুটি যখন বড় হয় তখন সেও একজন বাজে বাবা বা মায়ের ভূমিকাই অবতীর্ণ হয়।
তাহলে এখান থেকে উত্তরণ কি? প্যারেন্টিং সম্পর্কিত যে বাজে ধারণাগুলো আমরা এত বছর ধরে অনুশীলন ও অনুসরণ করে আসছি তা অবশ্যই আমাদের পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং সেই সাথে পিতামাতার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করা শিখতে হবে। আসুন আমরা কাউকে যেমন খুশি তেমন করার অধিকার না দিয়ে; বরং সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য হলেও এই বিষয় নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করি, তবেই আমরা বাচ্চাদের অধিকার রক্ষা করতে সক্ষম হবো। লেখক : সাংবাদিক।
সুত্র:জাগো নিউজ।
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.