শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাস করে কারাদ- দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা এ রায় দেন। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এ রায় অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একদিকে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, অন্যদিকে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের অধিকার সমুন্নত করবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে শ্রম আইন মেনে চলতে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠান এ ধরনের অপরাধগুলো করে আসছে ভবিষ্যতে তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুযোগ তৈরি হবে।
রায় শুনে আদালত থেকে বেরিয়ে যদিও ড. ইউনূস সাংবাদিকদের বলেছেন, বিনা দোষে তিনি সাজা পেয়েছেন। তার এ দাবি কিছু বিষয় সামনে তুলে এনেছে। সাংবাদিকদের কাছে তিনি নির্দোষ দাবি করলেও, আদালতে তা প্রমাণ করতে পারেননি কেন? অভিযোগের কী ব্যাখ্যা তিনি আদালতে দিয়েছেন? ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী ছিল? ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ আনা হয়, শ্রম আইন ২০০৬ ও শ্রম বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বা কর্মচারীদের শিক্ষানবিশকাল পার হলেও তাদের নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানে কমর্রত শ্রমিক বা কর্মচারীদের মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ দেওয়া হয়নি। গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি এবং লভ্যাংশের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী গঠিত তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি।
ড. ইউনূসের মতো একটি ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অনিয়ম মোটেও কাম্য নয়। যদিও বিচারক রায় পড়ে শোনানোর একপর্যায়ে বলেছেন, ‘এখানে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের বিচার হচ্ছে না। ড. ইউনূস, যিনি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, তার বিচার হচ্ছে।’ ফলে ধরে নিতে পারি, ‘ব্যক্তি ইউনূস’ এখানে অপরাধী নন। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান যিনি ছিলেন তিনি অপরাধ করেছেন। কিন্তু প্রধান ব্যক্তিটি যদি ড. ইউনূস হয়ে থাকেন, সেখানে এ অনিয়ম হয়ে থাকলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তিনি আমাদের আইডল, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি। গোটা বিশ্বে তার ভালো ইমেজ আছে। তিনি কেন এই ছোট অপরাধে অপরাধী হবেন? কিন্তু অন্যভাবে যদি বলি, এমন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিকে এই ছোট অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কি তার জন্য অসম্মানজনক হলো না?
রায় ঘোষণার পর অনেকেই বলেছেন দেশে কত বড় বড় অপরাধী, খুনি, চোরাকারবারি, দুর্নীতিবাজ আছেন যারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছেন। মানবাধিকারকর্মী আইরিন খান বলেছেন- ‘আমাদের দেশে কত রকমের অন্যায় হচ্ছে। আপনারাও জানেন। মানুষকে গুলি করেও মারা হয়েছে। সে-সবের কোনো বিচার নেই। কিন্তু ওনারা এখানে কী মামলা নিয়ে এসেছেন। ডিফেন্স পক্ষকে (আসামিপক্ষ) তো আইনটাকে বিশ্লেষণের সুযোগই দেওয়া হয়নি। তিনি (ড. ইউনূস) একজন নোবেল বিজয়ী। এই মানুষটি আমাদের সবাইকে গর্বিত করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে এ ধরনের একটা রায় হলো।’ সে কারণে আদালত বলেছে ‘এখানে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের বিচার হচ্ছে না। ড. ইউনূস, যিনি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, তার বিচার হচ্ছে।’ বড় অপরাধীদের বিচার হয় না অজুহাতে কোনো অপরাধের বিচার হবে না, তা হয় না। সব অপরাধেরই বিচার করতে হবে। অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। এখানে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, ড. ইউনূস সে অর্থে অপরাধী কি না? এছাড়া ড. ইউনূসের অপরাধগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন অপরাধ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ঘটছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত। দেশের ১৩টি শ্রম আদালতে ২৩ হাজার ৮৩০টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে ১ হাজার ২৫০টি মামলা। যদিও এ সংখ্যা প্রকৃত ভুক্তভোগীর চেয়ে অনেক কম। অনেকেই আছেন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতারিত হয়েও আইনের আশ্রয়ে যান না। ভাবেন অযথা ঝামেলা করে লাভ কী? কতদিনে মামলা নিষ্পত্তি হবে, কবে পাওনা বুঝে পাব, এসব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যারা কর্মীদের ঠকিয়ে যাচ্ছেন ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে তো?
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বা কর্মচারীদের শিক্ষানবিশকাল পার হলেও তাদের নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। আমাদের দেশে অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই এমন কাজ করে থাকে। কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়, চাকরি স্থায়ী হয় না। একজন কর্মচারী যে বেতনে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেন তা দিয়ে বছরের পর বছর পার হলেও ইনক্রিমেন্ট হয় না। এতে কর্মীদের আশা যে, চাকরিতে বেতন বাড়লে পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু ভালো থাকা যাবে সেটা আর হয় না। উল্টো জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে। রোজগারের টাকায় জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তার প্রতিষ্ঠানে কমর্রত শ্রমিক বা কর্মচারীদের মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ দেওয়া হয়নি। দেশের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যদি তুলনা করি, আমি বলব দেশের ৯০ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো তোলা যায়। যেখানে মাস শেষে বেতন পাওয়াও অনেক প্রতিষ্ঠানে অনিশ্চিত থাকে সেখানে ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ দেওয়া তো অকল্পনীয় বিষয়। এছড়া শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল, গ্র্যাচুইটি দেশের কয়টি প্রতিষ্ঠানে মেলে কেউ কি বলতে পারবেন? এর পরিসংখ্যান কি কারও কাছে বা কোথাও আছে?
মূলত আমাদের দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশের চিত্রই এরকম। নিয়োগ হয় অস্থায়ী। দীর্ঘদিনেও স্থায়ী হয় না। বেতন নিয়মিত হয় না। বছর বছর ইনক্রিমেন্ট মেলে না। গ্র্যাচুইটি, বিনোদন ভাতা তো বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই অলীক স্বপ্ন। এছাড়া চাকরি শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা দেয় কয়টা প্রতিষ্ঠানে? চাকরি জীবন শেষে একজন কর্মচারী খালি হাতে প্রতিষ্ঠান থেকে বের হন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে। এছাড়া চাকরির স্থায়িত্বেরও ঠিক নেই। যে কোনো কারণে যে কারও চাকরি চলে যায়। প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনে কর্মীকে চাকরিচ্যুত করে না। বরং কর্মী চাকরি ছেড়ে যেতে চাইলে, পারলে মাস শেষের বেতনটিও দিতে চায় না অনেক প্রতিষ্ঠান। তাই ড. ইউনূস বা গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ সাজার রায় শ্রম আদালতে ইতিহাস হয়ে থাকবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ড. ইউনূসের এ সাজার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কও রয়েছে। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ড. ইউনূসের দূরত্ব তৈরি হয়েছে বহু দিন আগে। সরকারের অভিযোগ, তিনি পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো এ কারণে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে আইনের মাধ্যমে তার অপসারণ এবং শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে তার সাজার যোগসূত্র তৈরি হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরও কোনো ছোট-বড় অনিয়ম পেলে ড. ইউনূসকে সেটারও মাশুল দিতে হতে পারে। এখানে নোবেল বিজয়ী বলে কোনো কথা নেই। শুধু ড. ইউনূস না, বিশে^র অনেক নোবেল বিজয়ীকে সরকারের নীতির বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য সাজাভোগ করতে হয়েছে।
যদিও বিশ্বের অন্য নোবেল বিজয়ীদের সাজাভোগের কারণগুলো ছিল মানুষের অধিকার সমুন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করতে গিয়ে সরকারের বিরাগভাজন হওয়া। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারি রোষানল যদি থাকে, তবে তা একেবারেই ভিন্ন। ড. ইউনূস মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে সরকারের বিরাগভাজন হননি। তবে এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, সরকার ড. ইউনূসের ওপর বিরাগভাজন থাকলেও অন্য নোবেল বিজয়ীদের মতো তাকে এখনো কোনো সাজাভোগ করতে হয়নি। আশা করি ভবিষ্যতেও সেটা করতে হবে না। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা এবং সাজার রায় আমি মনে করি, দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি বার্তা। শ্রম আইন লঙ্ঘন করে যারা শ্রমিক কর্মচারীদের দিনের পর দিন ঠকিয়ে আসছেন তাদের জন্য বার্তা এই যে, আইনের ওপর কেউ না। বিশ্ব খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিকে যখন আমরা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পেরেছি, এদেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিদেরও আমরা আইন লঙ্ঘনের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারব। সে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন। এতেই সার্থকতা মিলবে শ্রম আইনের।
লেখক: সাংবাদিক
zakpol74@gmail.com
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.