আব্দুল হাই রঞ্জু:
সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকতে হলে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের বিকল্প নেই। বিশেষ করে আমিষের পাশাপাশি সবজি খাওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। সব ধরনের সবজির চাষাবাদ দেশেই পর্যাপ্ত পরিমাণে হয়। যা দিয়ে আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনেকাংশেই পূরণ হয়। তবে এখনো দেশের মানুষের মধ্যে সবজি খাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। অথচ মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য দৈনন্দিন পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। এখন দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে দেদার রপ্তানিও হচ্ছে সবজি। সমস্যা হলো সামর্থ্যরে অভাবে বাড়তি দামের কারণে সবার পক্ষে সঠিক মাত্রার সবজি কেনাও সম্ভব হয় না।
বিশেষ করে শীতকালে প্রচুর পরিমাণে সবজির চাষাবাদ হয়। শিম, মুলা, টমেটো, বেগুন, শসা, মিষ্টি কুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, পেঁপে, আলুর ব্যাপক চাষাবাদ হয়। গত বছরও সবধরনের সবজির দাম সহনীয় পর্যায়ে ছিল। সবজির ভরা মৌসুমেও পেঁপে ও মুলা ছাড়া কোনো সবজিই ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন প্রতিকেজি বেগুন ৬০ থেকে ৮০ টাকা, শিম ৪৫ থেকে ৮০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকা, করলা ১০০ থেকে ১৪০ টাকা, প্রতি পিস ফুলকপি ৩০ থেকে ৫০ টাকা, প্রতি পিস বাঁধাকপি ৪০ থেকে ৫০ টাকা এবং প্রতি পিস লাউ ৬০ থেকে ৮০ টাকায় ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে। উত্তাপ ছড়াচ্ছে সবজি বাজার। ফলে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট বেড়েছে।
সমতল জমি, বাড়ির আঙিনা, বাড়ির ছাদ, পানির মাচায়, ঘরের চালে, চরাঞ্চলে, উপকূলীয় অঞ্চলে ও ভাসমান হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। কৃষিবিদরা মনে করেন, সুস্থ সবল বীজ আর যত্নে দেশের সব ধরনের মাটিতেই নানা রকম সবজি ফলানো সম্ভব। কৃষিতে গবেষণা বৃদ্ধি করে নতুন নতুন উদ্ভাবিত জাতের সবজি কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে সহসাই সবজি চাষের পরিধি বৃদ্ধি পাবে। প্রায় সব ধরনের সবজিতে ভিটামিনের উপস্থিতি রয়েছে। আবার সবজির যথেষ্ট পুষ্টিগুণও রয়েছে। বিশেষ করে কাঁচকলাতে প্রতি ১০০ গ্রামে পাওয়া যায় ৮৩ কিলো ক্যালরি খাদ্যশক্তি, ১৭.৩ গ্রাম শর্করা, ২.৬ গ্রাম আমিষ, ১ গ্রাম খনিজ লবণ, ০.১৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি এবং ভিটামিন সি পাওয়া যায় ৪ মিলিগ্রাম। এমনকি অন্যান্য কলার মতো এর শেকড়, কান্ড, পাতা, ফুল, থোড়ে রয়েছে প্রচুর ঔষধি গুণ। সবজির মধ্যে করলা, আলু, কুমড়া, লাউ, শসা, টমেটো, বেগুন, গাজরে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিগুণ রয়েছে। পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ সবজি এখন দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করে দেদার বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে। অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। যা সম্ভব হয়েছে কৃষি চাষাবাদের কারিগর এ দেশের কৃষকদের পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সবজি উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণ।
দুর্ভাগ্য হলো, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের অভাবে উৎপাদিত সবজি ও ফলের প্রায় ৩১ শতাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের ‘পোস্ট হারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট অব ফুড ভেজিটেবলস ফর ফুড সেফটি অ্যান্ড কোয়ালিটি’ শীর্ষক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, জমি থেকে ফসল উৎপাদন ও সংগ্রহের পর ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত এই বিপুল পরিমাণ সবজির একটি অংশ নষ্ট হয়ে যায়। অথচ সরকার গোটা দেশে সবজি সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগার নির্মাণ করে সবজি সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে চাষিদের আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে যেমন পড়তে হতো না, তেমনি উৎপাদিত সবজি স্বল্প খরচে হিমাগারে সংরক্ষণ করে সারা বছর উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি করতে পারত। আর এখন সবজি ফসলের মাঠ থেকে তুলে সরাসরি বাজারে নিয়ে যে কোনো দামেই হোক বিক্রি করতে হয়। কারণ সবজি পচনশীল পণ্য। এই পণ্যকে বিক্রি না করে কোনো উপায় থাকে না। ফলে সব ধরনের সবজি চাষিদের যে মূল্যে বিক্রি করতে হয়, সেই পণ্য হাতবদল হয়ে ফড়িয়া এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে নিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হয়। এতে চাষিরাও ক্ষতির মুখে পড়েন, আবার ভোক্তাদেরও বাড়তি দামে কিনে খেতে হয়।
আগে দেশের সব জেলাতে সবজির চাষাবাদ তেমন একটা হতো না। এখন সারা দেশেই প্রায় বারো মাস ধরে কম-বেশি সবধরনের সবজির চাষাবাদ হচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, নওগাঁসহ প্রায় সব জেলাতেই প্রচুর পরিমাণে সবজির চাষাবাদ হচ্ছে। এর বাইরে কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নরসিংদী, এমনকি টাঙ্গাইলসহ ঢাকার চারপাশ ঘিরে প্রচুর পরিমাণ সবজির চাষাবাদ হচ্ছে। কিন্তু এসব সবজি নগর, মহানগর, কিংবা শহরের হাটবাজারে উঠলে চাহিদার পুরোটাই পূরণ হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অনেক সময়ই সবজি চাষিরা সবজির উপযুক্ত মূল্য পান না। এখন হাটেবাজারে গেলে সাধারণ ভোক্তাদের এক কেজি আলু ৩০ থেকে ৪০ টাকা, ১ কেজি বেগুন ৮০ টাকা, মুলা ২০ টাকা অর্থাৎ যে কোনো সবজি ৫০/৬০ টাকার নিচে কিনতে পাওয়া যায় না। অথচ আলু চাষিরা মাঠ থেকে যখন আলু তোলেন তখন ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যেই ১ কেজি আলু বিক্রি করতে হয়। যা পরে হাতবদল হতে হতে হিমাগার পর্যন্ত পৌঁছে কেজিতে কয়েকগুণ দাম বেড়ে যায়। অথচ আলু একটি অতি নিত্যপণ্যের মধ্যে অন্যতম। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছুদিন আগে আলুসহ নিত্যপণ্যের বাজার দর বেঁধে দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। এখনো বাড়তি দামেই ভোক্তাদের সবজিসহ নিত্যপণ্য কিনতে হচ্ছে।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। বিশেষ করে এ দেশের কৃষককুল অনেক পরিশ্রমী। যাদের শ্রম মেধায় আজ কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা এসেছে। শুধু ধান, গম, কালাই, সরিষা, সবজিই নয় মাছ চাষ ও পশুপালনেও অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। নদী, নালা, বিলের মাছ তো এখন নেই বললেই চলে। একমাত্র মাছের আধুনিক চাষাবাদ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাছের চাহিদা পুরোপুরি ভাবেই পূরণ করছে। বলা যায়, মাছের চেয়ে এখন সবজির দাম তুলনামূলক বেশি। মূলত সবজি সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগার পরিকল্পিতভাবেই গোটা দেশেই স্থাপন করতে হবে। যেন কষ্টার্জিত সবজিচাষিদের উৎপাদিত সবজি সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে না যায়।
লেখক : কৃষি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
ahairanju@gmail.com
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.