ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
টেকনাফ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলছে। মংডুর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে দুই পক্ষই বোমা ও মর্টার শেল হামলা বাড়াচ্ছে। এতে সেখানে রোহিঙ্গা বসতিতে হতাহতের ঘটনা বাড়ায় পালাচ্ছে মানুষ।
সংঘাত বাড়ায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটিঘাটে মানুষ চলাচলে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া টেকনাফের কায়ুকখালী ঘাট এলাকায় ট্রলারে মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে নাফনদ জেটিঘাট জনশূন্য পড়েছে।
মঙ্গলবার (৭ মে) বিকাল ৫টার দিকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জালিয়াপাড়া গ্রামের ওপারে সুদারপাড়া থেকে থেমে থেমে আসা গোলার শব্দে এপার কেঁপে উঠছে। সীমান্তে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের ঘটনায় এপারে বসবাসকারীদের মাঝে অস্তিত্ব বাড়ছে।
সীমান্তে বসবাসকারীরা বলছেন, ‘মঙ্গলবার সকাল থেকে শুরু হওয়া আরাকান আর্মি ও সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে চলমান গোলা হামলার ঘটনায় এপারে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, খোনকারপাড়া, চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া ও দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন। আগের দিনের তুলনার এপারে গোলার শব্দ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এতে লোকজনের মাঝে অস্বস্তি বাড়ছে।’
দুপুরে জালিয়াপাড়া বেড়িবাঁধে উদ্বিগ্ন চোখে বসে ছিলেন বৃদ্ধ শফিক চৌধুরী। দিনমজুর শফিক জানালেন, ‘সীমান্তে গোলাবারুদের ব্যাপক শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওপারের গোলার শব্দে বাড়িঘর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এখুনি সব তছনছ হয়ে যাবে। অস্বস্তি নিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। রাতের তুলনায় দিনে আরও ব্যাপক গোলাবর্ষণ হচ্ছে। সীমান্তের লোকজন খুবই চিন্তিত। এই ভিটা-মাটি ছাড়া আর কোনও আশ্রয়স্থল আমাদের নেই। এটা ছেড়ে যাবো কোথায়? এখনও মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ হচ্ছে। বিশেষ করে রাত হলে পরিবারের লোকজন নিয়ে ভয়-ভীতিতে থাকতে হচ্ছে। অনেক সময় গোলার শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।’
মুন্ডারডেইল সীমান্তের বাসিন্দা জলিল মিয়া বলেন, 'আমাদের সীমান্তে নাফনদ না থাকলে পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ হতো। নাফনদের কারণে সীমান্তে দূরত্ব রয়েছে। না হয় যেভাবে গোলাবর্ষণ চলছে, এপারে হতাহত এড়ানো যেতো না। কিন্তু সীমান্তে এখন যে পরিস্থিতি তাতে আমরা খুব ভয়ে আছি। ওপারের গোলার শব্দ এত তীব্র যে এপারে আমরা আতঙ্কে চমকে উঠি। তবে মিয়ানমারে এভাবে যুদ্ধ চলমান থাকলে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে।’
ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মতে, গত কয়েকদিন ধরে মংডু টাউনশিপে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির ১ নম্বর সেক্টরে হামলা চালায় আরাকান আর্মি। বিজিপির ক্যাম্প দখলে নেয় তারা। কিন্তু বেদখল হয়ে যাওয়া বিজিপির সেক্টরটি পুনরুদ্ধারে হামলা শুরু করে সরকারি বাহিনী। এতে মংডুর রোহিঙ্গাদের আটটি গ্রামে ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঘরবাড়ি হারিয়ে আবার অনেকে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
তবে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (বিজিবি-২) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘রাখাইনের সংঘাত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবু সীমান্তে ও নাফনদ জেটিতে প্রয়োজন ছাড়া লোকজনকে ঘুরাঘুরি করতে নিষেধ করা হয়েছে। বিশেষ করে ওপারে চলমান সংঘাতের কারণে যেন কোনভাবে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে না পরে সেজন্য বিজিবি শক্ত অবস্থানে রয়েছে।’
টেকনাফ পৌরসভার নাফনদের কাছাকাছি বসবাসকারী মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্তে বড় ধরনের গোলার শব্দ এপারে পাওয়া যাচ্ছে। ভয়াবহ শব্দে আতঙ্কে অনেকের ঘুম ভাঙছে। এই সীমান্তের ওপারে মংডুতে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে আরকান আর্মি এবং জান্তা সরকারের মধ্য। গোলার বিকট শব্দে আমাদের ঘরবাড়ি কাঁপছে। অনেক সময় মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে।'
এদিকে দিন দিন সংঘাত বাড়ার কারণে মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভা সংলগ্ন নাফনদে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটি ঘাটে মানুষ চলাচলে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া টেকনাফ কায়ুকখালী ঘাটে ট্রলারে মাছ শিকার আপাতত বন্ধ রাখা রয়েছে।
সীমান্তের নাফ নদের ওপারে থেমে থেমে গুলিবর্ষণের কারণে সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে জানিয়েছেন টেকনাফ কায়ুকখালী বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘সীমান্তে পরিস্থিতি উত্তাল হওয়ায় আপাতত মাছ শিকার বন্ধ রয়েছে। তবে মাছ শিকার বন্ধে এই ঘাটের মাঝিমল্লাররা খুব কষ্টের জীবনযাপন করছেন।’
নাফনদে ট্রানজিট জেটি ঘাটে টোল আদায়কারী ইমাম হোসেন বলেন, ‘গত দুই দিন ধরে মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধে সীমান্ত উত্তাল। এ কারণে জেটি ঘাটে আগের মতো লোকজন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। গতকালের তুলনায় আজকেও সীমান্তে অনেক ভারী গোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এতে নাফনদ জেটি ঘাটে শূন্য পড়ে আছে।’
জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন,'ওপারে সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ায় সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মিয়ানমারে চলমান সংঘাতে সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সর্তক অবস্থায় রয়েছে। মানুষ যাতে নির্ভয়ে থাকে সেজন্য সীমান্তে বসবাসকারীদের খোঁজ রাখছি।’
এদিকে আরাকান আর্মি মংডু টাউনশিপ দখল করে নিয়েছে বলে অসমর্থিত সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। দেশটির সরকারি সংস্থা বিজিপির সদস্যদের কেউ কেউ বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। গত দুই দিনে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের ১২৮ জনের মতো বিজিপি সদস্য এ পারে আত্মসমর্পণ করেছে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের কাছে। নিরস্ত্র করে সবাইকে বিজিবির হেফাজতে রাখা হয়। বর্তমানে বিজিপির ১২৮ জনকে হ্নীলা উচ্চবিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে। এর আগে দুই দফায় পালিয়ে আসা মিয়ানমারের বিজিপি ও সেনাবাহিনীর ৬১৮ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। এর মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ২৮৮ জন বিজিপি-সেনা এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩৩০ জন বিজিপি, সেনা ও কাস্টমস কর্মকর্তাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠায় বাংলাদেশ।
ভয়েস/আআ/সূত্র: বাংলাট্রিবিউন
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.