সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী:
বিদ্যমান ব্যবস্থাধীন থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের পরিত্রাণের কোনোই উপায় নেই। তাহলে উপায় কী? উপায়টা কী তা বলা কিন্তু সহজ। ব্যবস্থার বদল চাই। কোনো একটি দেশে নয়, পৃথিবীব্যাপী। ব্যাধিটা সর্বত্রব্যাপ্ত, করোনা ভাইরাসের মতোই। তার প্রতিকারও আন্তর্জাতিকভাবেই করতে হবে; তবে শুরু করা প্রয়োজন প্রত্যেকটি দেশেই। সমাজ পরিবর্তনের বিশ্বব্যাপ্ত ওই আন্দোলন নতুন যে আন্তর্জাতিকতা গড়ে তুলবে সেটা মুনাফাকেন্দ্রিক হবে না; হবে সহমর্মিতা ও সহযোগিতাকেন্দ্রিক। এর জন্য দরকার পড়বে ব্যাপক ও গভীর সাংস্কৃতিক কাজের। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা সংস্কৃতির মানবিক উন্নতির পথে মস্ত বাধা। অতিশয় উন্নত দেশেও তাই দেখা যায় সাংস্কৃতিক অন্ধকার। যেমন করোনার টিকাবিরোধী আন্দোলন। সেটা বাংলাদেশের মতো পশ্চাৎপদ দেশের মানুষ কিন্তু করেনি; উন্নত ইউরোপ ও আমেরিকার মানুষই করেছে। অথবা ধরা যাক ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর শ্বেত আমেরিকানদের আস্থার ব্যাপারটা। অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্য। আগামী নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হলেও বিস্ময়ের কারণ হবে না। বিশ্বব্যাপী চলছে নব্য হিটলারদের শাসন ও শোষণ।
উন্নত সংস্কৃতির জন্য উন্নত আদর্শ আবশ্যক। সেটি অবশ্যই হবে পুঁজিবাদবিরোধী এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারে আবদ্ধ। না, ব্যবস্থার সংস্কারে কুলাবে না, দরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনই। এটা তো মোটেই অজানা নয় যে, সংস্কারের মূল অভিপ্রায়টা হচ্ছে ব্যবস্থাটাকে রক্ষা করা, তাকে বদলানো নয়। অনেক ক্ষেত্রেই পুরনো জিনিসকেই নতুন মোড়ক দিয়ে হাজির করা হয়। সংস্কারের নমুনা হচ্ছে সর্বজননিন্দিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বদলে সেখানে নতুন বিধিমালা জারি করা, যাতে পুরনো আইনের মতপ্রকাশের অধিকার হরণকারী ধারাগুলো ঠিকই থাকবে তবে আচ্ছাদনটা হবে নতুন, যেমন সংস্কার পদক্ষেপ বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিটি নিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এসব নয়ছয় ছলনা মাত্র, প্রতারণাও বলা চলে এবং সবটাই ব্যবস্থাটাকে রক্ষা করার স্বার্থে।
বিক্ষিপ্তভাবে ভালো খবর পাওয়া যায়। এমনকি এমনও শোনা যায়, যে পরিবর্তনের একটা হাওয়া ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী বইতে শুরু করেছে, যেমনটা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আমাদের জানাচ্ছে। তাদের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলছে : একনায়কদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এক বছরে কমেছে কর্তৃত্ববাদীদের দাপট। ঝুঁকি সত্ত্বেও প্রতিবাদে নেমেছে মানুষ। কারচুপির পরও নির্ভার নয় শাসকরা এবং গণতন্ত্রীদের আবেদন আরও শক্তিশালী হচ্ছে।
এসব খবর ভালো তো অবশ্যই, তবে মোটেই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে পুতিনরা যখন তৎপর রয়েছেন। মৌলিক পরিবর্তনের জায়গাটাতে হাত দেওয়া চাই। সেটা অবশ্য বলা যত সহজ, করা ঠিক ততটাই কঠিন। কিন্তু না করে তো উপায় নেই। বদল করার কথা বহু মনীষী বলেছেন। আজ থেকে একশ বছর আগে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ নামে যে অসাধারণ একটি কবিতা লিখেছিলেন তাতে ওই বদলের আবশ্যকতার কথাটা শুনতে পাই। পরবর্তী সময় তিনি তার বক্তব্য আরও পরিষ্কার করেছেন, বলেছেন সমাজ বিপ্লবের অত্যাবশ্যকতার বিষয়ে। যেমনটা পাওয়া যায় তার ‘কুলি-মজুর’ নামের কবিতাটিতে। কবিতাটিকে তিনি স্থান দিয়েছিলেন তার সাম্যবাদী নামের কবিতার বইতে। প্রকাশকাল ১৯২৫। ছোট্ট ওই কবিতাটি আমাদের খুবই পরিচিত। কবি বলছেন সেদিন রেল গাড়িতে তিনি দেখলেন ‘কুলি বলে’ এক বাবুসাব একজনকে ঠেলে নিচে ফেলে দিচ্ছে। দেখে কবির চোখে এলো জল, তার মনে প্রশ্ন জাগল, ‘এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’ জবাবে তিনি বলছেন, না, মার খাবে না। কারণ বিশ্বব্যাপী একটি জাগরণ এসেছে, ‘আজ নিখিলের বেদনা-আর্তপীড়িতের মাখি খুন/ লালে লাল হয়ে উঠেছে নবীন প্রভাতের নবারুণ।’ তা নতুন সূর্য উঠেছিল বৈকি। রুশ দেশে বিপ্লব ঘটেছিল ১৯১৭ সালে। কিন্তু পরবর্তীতে সেই নবীন সূর্যকে ঢেকে ফেলেছে প্রাচীন অন্ধকার। কবির ভাষাতে বলতে গেলে জয় হয়েছে শয়তানের।
নজরুলের ‘কুলি-মজুর’ কবিতার তিন দশক আগে, ১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তার কালজয়ী কবিতা ‘দুই বিঘা জমি’। তাতে ছিল সামন্তবাদী শোষণের মর্মান্তিক এক ছবি এবং প্রচণ্ড এক ধিক্কার। কৃষিজীবী উপেনের ছিল শুধু দুই বিঘা জমি; জমিদার বাবুর ইচ্ছে হয়েছে নিজের বাগানটিকে তিনি প্রশস্ত করবেন, তাই জমিটি কিনে নিতে চাইলেন। উপেন রাজি হননি; ওইটুকুই তো তার সম্বল, মরিবার মতো ঠাঁই। পরে জমিদার উপেনের দুই বিঘা হাতিয়ে নিলেন; উপেনের বিরুদ্ধে আদালত থেকে ডিক্রি নিয়ে এলেন তিনি, মিথ্যা ঋণের খাতে। সাতপুরুষের বসতবাড়ি হারিয়ে ভূমিহীন উপেন বুঝলেন, ‘এ জগতে হায় সে-ই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।’ নিরাশ্রয় উপেন সন্ন্যাসী হয়েছেন, দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কিন্তু নিজের বসতবাড়িটির কথা কিছুতেই ভুলতে পারেননি। তারই টানে বছর পনেরো-ষোলো পরে ফিরে এসেছেন ভিটেবাড়িতে। এসে দেখেন সবকিছু বদলে গেছে। তার জমির চিহ্নটি পর্যন্ত নেই। ‘দেবী’ হয়ে গেছে ‘দাসী’। প্রাচীরের পাশে পুরনো আমগাছটি আছে দেখে তার নিচে গিয়ে বসেছেন উপেন। গাছ থেকে দুটি পাকা আম মাটিতে পড়লে যেই কুড়িয়ে নিয়েছেন, অমনি দারোয়ান এসে চড়াও হয়েছে। চাটুকারদের নিয়ে বাবু মাছ ধরছিলেন পুকুরে ছিপ ফেলে, তার কাছে গিয়ে উপেন বলেছেন, দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়। শুনে বাবু বলে ওঠেন, ‘বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।’ উপেন আর কী করেন, আপন মনে ধিক্কার দেন; ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে’। সম্পত্তি মানেই যে চুরি এটি তো প্রতিষ্ঠিত সত্য; কিন্তু চোর যে আবার সাধু হয়ে বসে, অতিরিক্ত দুঃখটা সেখানেই।
নজরুলের সময়ে এসে রবীন্দ্রনাথের বাস্তুহারা উপেনরা কুলি-মজুরে পরিণত হয়েছে। সংঘবদ্ধ হয়ে তারা বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছে। সফলও হয়েছে কোথাও কোথাও, যদিও সাফল্যকে ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, নজরুল যাকে ‘মহা-উত্থান’ বলেছেন সেটি ঘটানো ছাড়া মানুষের পক্ষে মানুষের মতো বাঁচার কোনো উপায় নেই। সব ভালো যার শেষ ভালো; মানুষের সভ্যতা আজ একটি ক্রান্তি সীমায় এসে পৌঁছেছে, যেখানে প্রশ্ন উঠেছে কোন দিকে সে এগোবে, ধ্বংসের নাকি নবসৃষ্টির? আমেরিকার কবি রবার্ট ফ্রস্টের লেখা কবিতার একটি পঙ্্ক্তি আমাদের খুবই পরিচিত। কবি দেখেন বনের মধ্যে দুটি পথ দুটি দিকে গেছে চলে; একটি পথে ভিড় বেশি, অন্যটিতে কম, কিন্তু এই দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছিলেন তিনি, আর তাতে তার জন্য সবকিছু বদলে গিয়েছিল। জনাকীর্ণ পথটি যদি হয় ব্যক্তিমালিকানার, অপেক্ষাকৃত নির্জন পথটি, তবে সামাজিক মালিকানার। দ্বিতীয় পথটিই সৃষ্টির, প্রথম পথটি নয়।
দ্বিতীয় পথে সভ্যতার যাত্রার জন্য ভরসা বুদ্ধিমান ও বিবেকবান মানুষদের ওপর। বিশেষভাবে তরুণদের ওপর। সব দেশেই, আমাদের দেশেও। আমাদের যে তরুণরা একাত্তরে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়েছে এবং এখনো অন্যত্র না পারলেও সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, ভরসা তারাই। তবে কেবল যে বুদ্ধি ও বিবেকেই কুলাবে তা নয়, সাহসও চাই। নির্বাচন কমিশন গঠনে কোন কোন বিবেচনা সামনে আনা দরকার জানতে চাইলে বিশিষ্ট নাগরিকরা কেউ কেউ যে বলেছিলেন সততা, নিরপেক্ষতা, দেশপ্রেম ওসব তো চাই-ই, চাই সাহসও। সেটি খুবই যথার্থ পরামর্শ। সাহস যে খুব উন্নত নৈতিক গুণ তা কেউ বলবেন না, তবে এটি সেই গুণ, যেটি না থাকলে অন্য গুণগুলো দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, নেতিয়ে পড়ে দুর্বল হাঁটুর মানুষের মতো; নয়তো সঙ্কুচিত হয়ে যায়, লজ্জাবতী লতার মতো। সাহস ছিল বলেই একদা আমরা যুদ্ধ করেছি এবং রাজনৈতিকভাবে হলেও স্বাধীন হয়েছি, নইলে মার খেয়ে শেষ হয়ে যেতাম। বিশ্ব জুড়েই এখন উলঙ্গ ফ্যাসিবাদী ত্রাসের ভয়াবহ রাজত্ব চলছে।
মানুষ ভয় পাচ্ছে, কারণ দেখছে সে একাকী। সাহস আসে একত্র হলে, একাকিত্বের পরিণতি দাঁড়ায় পরাজয়ে শত্রুর কাছে তো বটেই, ভয়ের কাছেও, সেটাই ঘটে আগে। ভয় পেয়ে ভালো মানুষেরা যে এখন সঙ্কুচিত বিপদের ওপর মহাবিপদটা কিন্তু সেখানেই, ভয়-পাওয়ার দরুন পরস্পরবিচ্ছিন্নতাই আজ তাই ঐক্য চাই। বিবেকবান, বুদ্ধিমান ও সাহসী মানুষদের। এবং তার জন্য দরকার যে সাংস্কৃতিক উন্নতির, যেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই।
আর মূল কথাটা কিন্তু আসলে একটাই। ভালো খবর তখনই আসবে যখন সমাজ-পরিবর্তনের সর্বাত্মক দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আন্দোলন এগোতে থাকবে। যতটা এগোবে, ভালো খবর ততটাই আসবে। শুধু ক্ষোভ-বিক্ষোভে কাজ হওয়ার নয়, হা-হুতাশে তো নয়ই।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2024 Coxsbazar Voice. All rights reserved.