সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী:
এমন অবস্থা চলতে পারে না। বিশ্বময় একই আওয়াজ। কিন্তু অবস্থাটা বদলাবার আগে তো পরিষ্কার ধারণা চাই অবস্থার কারণ কী। আগে রোগটিকে চিহ্নিতকরণ, তারপর না ব্যবস্থাপত্র প্রণয়ন। বর্তমান অবস্থাটা প্রোথিত রয়েছে বিশেষ ধরনের ব্যবস্থার ভেতরে। এক কথায় সে ব্যবস্থাটা নামে পুঁজিবাদ। কথাটা স্থূল, কিন্তু এটা জোরেশোরে বলা হচ্ছে না। রক্ষণশীলরা বলবেন না, কারণ এই ব্যবস্থাটাকে তারা পছন্দ করেন তা তারা মার্কিনপন্থি বা জেহাদপন্থি, যে পন্থিই হোন না কেন। সম্পত্তি ও সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থাটাকে তারা রক্ষা করতে চান। ব্যবস্থা বদলাবার কথাটা উদারনীতিকরা যে তোলেন না, তার কারণ একে তারা ভদ্রলোক, তদুপরি তারা মনে করেন সংস্কারেই কুলাবে। এবং তৃতীয়ত তারা যে গাছে বসে আছেন তার গোড়াটি কেটে ফেলতে চাইবেন এমনটা তো স্বাভাবিক নয়। হ্যাঁ, বদলাবার কথা বামপন্থিরা বলেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে তারা সামাজিক মালিকানার নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে চান। কিন্তু তাদের কণ্ঠ রোধ করা হয়। রাষ্ট্র, সমাজ, মিডিয়া, সবাই মিলে তাদের গলা চেপে ধরে। ফিলিস্তিনিদের গলা যেভাবে চেপে ধরা হচ্ছে প্রায় সেভাবেই।
মধ্যবর্তী উদারপন্থিদের নিয়ে মস্ত সমস্যা। তারা বুঝতে চান না। বুঝতে গেলে দেখেন ঘুমন্তকে জাগিয়ে দেওয়ার এবং ক্ষেত্রবিশেষে পাগলকে ক্ষেপিয়ে তোলার ঝুঁকিটা রয়ে গেছে সামনে। স্বভাবতই তারা দু’কদম এগোতে গেলে অন্তত এক কদম পিছিয়ে আসেন এবং পেছানো অবস্থানেই দাঁড়িয়ে থাকেন।
পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা এখন ধনী-দরিদ্র সব দেশের মানুষকেই লড়তে হবে। লড়তে হবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। বাংলাদেশে এ লড়াইয়ের জন্য বিশেষভাবে যা প্রয়োজন হবে তা হচ্ছে জ্ঞানের চর্চা। জ্ঞানের জন্য জ্ঞান নয়, মাকড়সার জাল তৈরির জ্ঞান নয়, মানুষের জ্ঞান; যে জ্ঞান পৃথিবীটাকে ব্যাখ্যা করবে, পৃথিবীটাকে বদলানোর জন্য। এক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে তাকাতে হবে কিশোরদের দিকে। যাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির জন্য যাদের ওপরে অনেকটাই নির্ভর করা যাবে, নির্ভর করতে হবেও। এদের সচেতন ও সংগঠিত করতে হলে দেশে একটি কিশোর আন্দোলন গড়ে তোলা চাই। বলা বাহুল্য এ আন্দোলন আগের কিশোর আন্দোলনগুলোর মতো হলে চলবে না। এর লক্ষ্য হবে সুস্পষ্ট। সেটি সমাজ পরিবর্তনের।
কারা করবেন এসব কাজ? করবেন তারা যারা মনে করেন বিদ্যমান অবস্থার বদল চাই এবং একে বদলাতে হলে গোটা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক রূপান্তর ঘটানো অত্যাবশ্যক।
বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া? এত সব কথা বলাকওয়া শেষে সামান্য এই উপসংহার? এই উপসংহারে কিন্তু অন্যকথাও উহ্য আছে। সেটা হলো এই যে, মূল কাজটা রাজনৈতিক। সমাজ-পরিবর্তনের আন্দোলন যাকে বলছি তার চরিত্র অবশ্যই রাজনৈতিক হবে। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ভিত চাই। সংস্কৃতি-সচেতনতা বৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক মান উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়া সম্ভব না হলে রাজনীতি প্রাণবন্ত হবে না, এগোবেও না। এখন যেমনটা দেখতে পাচ্ছি।
সংস্কৃতির নিজের ভিত্তিটা হচ্ছে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। ওই ব্যবস্থা সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এটা সত্য, তবে সংস্কৃতি নিজেও যে ব্যবস্থা বদলাতে একটা ভূমিকা রাখে সেটাও মিথ্যা নয়। সর্বত্র সংস্কৃতির ব্যাপারটা উপস্থিত, থাকতে বাধ্য। কিশোর আন্দোলনের কথা যে বলছিলাম সেটা এসেছে বড় সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরই অংশ হিসেবে। আগের দিনের কিশোর আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ছিল এইখানে যে, সেটা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বৃত্তের বাইরে যায়নি। এখনকার কিশোর আন্দোলনকে ওই বৃত্তটা ভাঙতে হবে। আর এই আন্দোলন কোনোভাবেই আদর্শনিরপেক্ষ হবে না। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য সমাজবিপ্লব। সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক উভয় আন্দোলনেরই প্রবহমানতা হওয়া চাই একই ধারায়।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন চরম বন্ধ্যত্ব ও ভয়াবহ অন্ধকার বিরাজ করছে। সংস্কৃতির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে মিলন। সে মিলন ঘটছে না। মানুষ বিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। ঘরে বন্দি হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস যে কাজটা করেছিল সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই জিনিসটাই ঘটছে। বিভিন্ন মাত্রায়। ঘরের বিনোদন আকাশ পথে আসছে। আমরা জানি সংস্কৃতির প্রাণ থাকে সৃষ্টিশীলতায়। সেই সৃষ্টিশীলতা সামাজিকভাবেই কাজ করে। সৃষ্টিশীলতার জন্য সামাজিকতার পাশাপাশি জ্ঞানের দরকার হয়। দরকার পড়ে সচেতনতার। জ্ঞান এবং সচেতনতা না থাকলে সৃষ্টিশীলতা এগোয় না, তার মান বৃদ্ধি পরের কথা।
যে অন্ধকার আজকে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে তাতে সৃষ্টিশীলতার জায়গাতে সহিংসতাই বরঞ্চ বাড়ছে। দেখা দিচ্ছে হতাশা। মানুষ অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়ছে। ভরসাহীন জগতে মাদকের আসক্তি বাড়ছে, আবার ধর্মের দিকেও ঝুঁকেছে অনেকে। সেটাও এক আসক্তি বটে। অনেক মানুষই ভাবছে ঈশ্বর ছাড়া আর কোনো ত্রাণকর্তা নেই; পরকাল ছাড়া সুখের আশা ব্যর্থতারই প্রতিশ্রুতি। এই মনোভাব আত্মসমর্পণের এবং আত্মসমর্পণ খুব বেশি দূরে থাকে না নৈতিক আত্মহত্যা থেকে। মৌলবাদী তৎপরতা বাড়ছে বলে খবর আসছে। এই তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে ইহজাগতিক আদর্শবাদের চর্চার সীমিতকরণ প্রত্যক্ষরূপে জড়িত। কত আগে বিদ্যাসাগর ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করেছেন। সেই চর্চা এগিয়েছে, কিন্তু ব্যাপক হয়নি। বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীলদের তো কথাই নেই, প্রগতিশীলরাও অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা আর মুখে আনেন না, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু বলার কথাও নয়, প্রতিষ্ঠা করার কথা। প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হচ্ছে ইহজগৎকে প্রধান করে তোলা। কেবল প্রধান নয়, আকর্ষণীয়ও। আকর্ষণীয় করতে হলে একে বদলাতে হবে। বদলানোটা এমনি এমনি ঘটবে না, তার জন্য আন্দোলন চাই। সমাজ-বদলের আন্দোলন যত এগোবে মানুষ ততই আশাবাদী হবে, আস্থা বাড়বে নিজের ক্ষমতাতে, স্বর্গ গড়তে চাইবে এই পৃথিবীতেই। অন্ধকারকে লাঠি দিয়ে পেটালে সে পালাবে না, গুলি করলেও মরবে না, অন্ধকার দূর হবে আলো জ্বালালে। সেই আলো সংস্কৃতির।
বিদ্যাসাগর বিশ্বাস করতেন জ্ঞান ছড়িয়ে সমাজের রূপান্তর ঘটাবেন। সে পন্থায় সাফল্য আসেনি। সমাজ-কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। নাট্যকার ইবসেনের আস্থা ছিল ব্যক্তির বিদ্রোহে। তবে তাতে যে খুব একটা কাজ হবে না তাও তিনি জানতেন। কাজ হয়ও-নি। মার্কস বলেছেন, সমাজ রূপান্তর আসবে সমাজের বেশিরভাগ মানুষের সমষ্টিগত উদ্যোগে। ওই পথে লেনিন এগিয়েছেন। মাও সে তুঙ এগিয়েছেন। তাদের দেশে বিপ্লব হয়েছে। সমাজবিপ্লবের পথ সমাজের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের উদ্যোগেই ঘটবে। এই মানুষদের বুঝতে হবে যে বিদ্যমান অবস্থাটা বদলানো চাই। কারণ এই ব্যবস্থা টিকে থাকলে মানুষের প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। ব্যবস্থাটাকে প্রবলভাবে ঘৃণা করা চাই। ঘৃণার পেছনে থাকবে ভালোবাসা। নতুন স্বপ্নের প্রতি ভালোবাসা। ভালোবাসা কখনো গভীর হয় না সঙ্গে ঘৃণা না থাকলে। ঘৃণাহীন ভালোবাসা বলে আসলে কিছু নেই। সাহিত্যে এমন খবর পাওয়া যায় যে, নায়ক বলছে নায়িকার ত্রুটিগুলোর তালিকা তৈরি করতে গিয়ে ওই ত্রুটিগুলোকেই সে ভালোবেসে বসে আছে। জীবনের সত্যটা ভিন্ন প্রকৃতির। সেটা হলো প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পরের দোষগুলোকে খুব বেশি দিন ভালোবাসে না, সহ্য করতে পারে হয় তো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঘৃণা জমে ওঠে, চায় সংশোধন ঘটুক। ভালোবাসা দ্বন্দ্ববিহীন নয়। সমাজ-পরিবর্তনের জন্যও এই দ্বন্দ্বটাকে তীব্র করা চাই। নতুন সমাজ গড়তে চাই বলেই পুরনো সমাজকে ঘৃণা করি। এই ঘৃণা ও ভালোবাসাকে একই সঙ্গে গভীর, ব্যাপক ও তীব্র করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আন্দোলনের অপরিহার্য সহযোগী হিসেবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলাটা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে ভুললে চলবে না যে, এ যুগ মিডিয়ার, মিডিয়া পারে না এমন কাজ নেই। সমাজ-বিপ্লবীদের পক্ষে এই সত্যকে উপেক্ষা করলে কাজ হবে না। তাদের নিজস্ব গণমাধ্যম চাই। সে গণমাধ্যম গড়ে তুলতে পারলে পুঁজিওয়ালাদের-কুক্ষিগত গণমাধ্যমও অনুকূল সাড়া দেবে। তারচেয়েও বড় কথা যেটা সেটা হলো পুঁজিবাদী গণমাধ্যম যেভাবে প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার করেছে, খবরকে নিজেদের প্রয়োজন মতো সাজাচ্ছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার ব্যাখ্যা করছে, সেসবের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করা চাই এবং একই সঙ্গে চাই ঘটনার সঠিক ছবি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা। জ্ঞানের সুস্থ চর্চার জন্য এ কাজ অত্যাবশ্যকীয়।
এক্ষেত্রে এটা স্মরণীয় যে, মন্দের বড় ভরসা ভালোর দুর্বলতা। আর ভালো কখনোই শক্তিশালী হবে না, পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত না হতে পারলে। ভালোর পক্ষের মানুষদের তাই ঐক্যবদ্ধ হওয়া চাই; সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে এবং অতি অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে। এ ঐক্য দেশের ভেতরে হবে, হবে আঞ্চলিকভাবে, একই সঙ্গে তাকে হতে হবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। কিন্তু এর কোনো একক আন্তর্জাতিক কেন্দ্র থাকার দরকার নেই, যেমনটা আগে ছিল।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.