ডাঃ মনিকা বেগ:
বাংলাদেশ একটি বহুমাত্রিক সমাজ যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে উদ্ভূত এই রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্য। কিন্তু গত কয়েক দশকে আমরা দেখেছি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান, যা কেবল আমাদের জাতীয় ঐক্যকেই নয়, বরং সমাজে নারীর অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
একটি বিষয় সুস্পষ্ট: ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শুধুমাত্র একটি আদর্শ নয়, এটি একটি ক্ষমতার কৌশল। এটি নারীর ওপর এক ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা, যা নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যকে আরও গভীর করে। এই ধরণের রাজনীতির প্রভাব প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ - কখনো এটি আইন, শিক্ষাব্যবস্থা বা নীতিমালার মাধ্যমে নারীর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, আবার কখনো সামাজিক প্রভাবের মাধ্যমে তার স্বাধীনতাকে খর্ব করে।
নারীর ভূমিকা ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি:
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সাধারণত নারীর ভূমিকা সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট আদর্শিক ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এটি প্রায়শই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে ধর্মীয় মোড়কে বৈধতা দেয়। যেমন, নারীর ভূমিকা শুধুমাত্র স্ত্রী, মা বা গৃহকর্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর মাধ্যমে নারীর স্বাধীনতা, তার সম্ভাবনা এবং তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধই করা হয় না, সুযোগ পেলে অস্বীকারও করা হয়।
অন্যদিকে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সমর্থনকারীরা যুক্তি দেন যে এটি সামাজিক নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের রক্ষাকর্তা। কিন্তু এই ‘নৈতিকতা’ মূলত একপাক্ষিক এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক। নারীর পোশাক বা আচরণ নিয়ে যে ধরনের বিধিনিষেধ আরোপিত হয়, তা পুরুষদের উপর আরোপিত হয় না। এই একপেশে নীতি নারীর জন্য এক ধরনের নিঃশব্দ শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়ায়, যা তাকে সমাজের মূলধারায় সমান অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করে।
শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে প্রভাব:
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নারীর জন্য একধরনের অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে। এটি নারীর শিক্ষাকে শুধু সীমাবদ্ধ নয়, অনেক ক্ষেত্রেই নিরুৎসাহিত করে। কিছু ধর্মভিত্তিক দলের বক্তব্যে এবং কর্মসূচিতে আমরা দেখেছি, নারীদের উচ্চশিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ নিয়ে তাদের নেতিবাচক মনোভাব কতটা গভীর। তারা মনে করে, নারীর আসল ভূমিকা ঘরে - পরিবারের দেখভাল এবং সন্তান প্রতিপালন করা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজকের বাংলাদেশে নারীশিক্ষা এবং নারীর কর্মসংস্থান দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। পোশাকশিল্প থেকে শুরু করে সরকারি প্রশাসন, এমনকি বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগে নারীর অংশগ্রহণ আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নারীর এই সাফল্য, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিবিদদের দ্বারা প্রচারিত নারীর তথাকথিত ‘সীমাবদ্ধতাগুলোকে’ স্পষ্টভাবে অস্বীকার করে।
নারীর অধিকার বনাম ধর্মীয় আইনের দ্বন্দ্ব:
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আরেকটি বড় সমস্যা হলো এটি আইনের মাধ্যমে নারীর অধিকারকে সংকুচিত করার চেষ্টা করে। এর উদাহরণ হতে পারে বিদ্যমান পারিবারিক আইন - যেখানে বিয়ে, তালাক বা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে ধর্মভিত্তিক বিধান নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক। ধর্মীয় বিধানকে অন্ধভাবে রাজনীতিতে প্রয়োগ করা হলে, মানুষ হিসেবে নারীর মৌলিক অধিকার গুলো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বাস্তবে রূপান্তরিত হবে।
শুধু তাই নয়, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রস্তাবিত নীতিগুলো নারীর প্রজনন স্বাধীনতা এবং তার নিজের শরীরের উপর তার অধিকারকেও হরণ করতে পারে। এটি কেবল একজন নারীর ব্যক্তিগত জীবনের ওপর আঘাত নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক উন্নয়নের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সহিংসতার বৈধতা এবং নৈতিক দ্বিচারিতা:
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অনেক সময় এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি করে যেখানে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উপেক্ষা করা হয় অথবা ‘ন্যায্যতা‘ দেওয়া হয়। ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার ঘটনায় ভুক্তভোগীকে দায়ী করার সংস্কৃতি প্রাথমিকভাবে পিতৃতন্ত্র থেকে আসলেও, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সেটিকে আরও শক্তিশালী করে। এর ফলে সহিংসতার শিকার নারীরা ন্যায়বিচার পাওয়া তো দূরের কথা, বরং নিজেদেরই দোষী মনে করতে বাধ্য হয়।
সমাজের বিভাজন এবং নারীশক্তির ভবিষ্যৎ:
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আমাদের সমাজকে বিভক্ত করে। এটি একদলকে ‘নৈতিক‘ এবং অন্য দলকে ‘অনৈতিক‘ হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে বিভাজন সৃষ্টি করে। এই বিভাজন নারীদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার পথেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের উচিত এই বিভেদকামী রাজনীতির প্রলোভন থেকে দূরে থাকা এবং অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
বাংলাদেশের নারীশক্তি ঐতিহাসিকভাবে প্রগতির অন্যতম চালিকা শক্তি। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা, সাম্প্রতিককালের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের অবদান, কিংবা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে, বিশেষ করে ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে তাদের নেতৃত্ব এবং স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ - সবকিছুই প্রমাণ করে যে নারীরা প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজ উদ্যমে ও নিজ যোগ্যতায় সামনে এগিয়ে যেতে পারে।
তাই, একজন সচেতন নাগরিক এবং একজন নারী হিসেবে আমাদের বুঝতে হবে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কেবল আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং অধিকার হরণ করে না, এটি আমাদের জাতির অগ্রগতিকেও থামিয়ে দিতে পারে। ধর্মকে অবশ্যই ব্যক্তি এবং সমাজের নৈতিক উন্নতির জন্য ব্যবহার করা উচিত, কিন্তু সেটিকে রাজনীতির হাতিয়ার বানানো হলে তা বিভেদ এবং বৈষম্য বাড়াবে বৈ কমাবে না।
পরিশেষে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে বর্জন করা মানে ধর্মকে অস্বীকার করা নয়, বরং রাজনীতিতে সমতা, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের নীতি প্রতিষ্ঠা করা। নারীর জন্য একটি প্রগতিশীল, সহানুভূতিশীল এবং সমান-সুযোগ নিশ্চিত করে এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হলে আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেই হবে।
লেখক- ডাঃ মনিকা বেগ।
সাবেক প্রধান এবং বৈশ্বিক সমন্বয়ক।
এইচআইভি/এইডস সেকশন, জাতিসংঘ সদর দপ্তর, ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.