ড. এম আর ইসলাম:
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরপেক্ষ নির্বাচন সবেচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিগত রাজনৈতিক সরকারগুলো নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করেছিল। স্বাধীনতা উত্তরকালে কোনও রাজনৈতিক সরকারই জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু হতে দেয়নি সামগ্রিকভাবে। ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে তারা নির্বাচনে সুক্ষ ও স্থুল, উভয় প্রকার হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধা করেনি। তাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দলগুলো সোচ্চার হয়; কিন্তু তারাই আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে অগ্রাহ্য করে ক্ষমতায় গেলো।
নির্বাচনকে প্রভাবিত বা নির্বাচন সংক্রান্ত দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা টেক্সটবুক এক্সাম্পেল। কতভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা যায়, তা এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আমার ধারণা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারগুলো রাশিয়া, চিলি, ফিলিপাইন, উগান্ডা, তুরস্কের নির্বাচন জালিয়াতির বিভিন্ন পন্থাকে অনুসরণ করে ঘনিষ্ঠভাবে। ভালো কিছু নিতে রাজনৈতিক সরকারগুলোর সাংঘাতিক অনাগ্রহ।
জুলাই বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র মেরামতের যে প্রত্যয় নিয়েছিলো, তা অনুযায়ী নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো অন্যতম প্রাধান্য হওয়া উচিত। কিন্তু সেই লক্ষে এই সরকার কতটুকু আগালো তার নিমিত্তেই এই আলোচনা। এক্ষেত্রে নির্বাচন সংক্রান্ত আইনের চেয়ে বেশি বোঝা দরকার বর্তমান সরকারের এই ক্ষেত্রে পলিসি কী। কোনও সন্দেহ নেই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ সংক্রান্ত আইনটি যা ২০২২ সালে তৈরি করা ছিল, তা যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ। উক্ত আইনে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের যোগ্যতা ও সাম্যক পদ্ধতি সম্পর্কে তেমন কিছুই আলোকপাত করা নেই, যার কারণে অযোগ্য বা পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের এমন কমিশনে আসার সুযোগ আছে।
কোনও সন্দেহ নেই যে যোগ্য ব্যক্তি আর উপযুক্ত পরিবেশ বা প্রভাবমুক্ত পেশাগত অবস্থান নিশ্চিত না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব না। নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইন সংশোধন না করে, কমিশনারদের যোগ্যতা ও পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ না করে হঠাৎ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে জনমনে আশংকা এই নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে কতটা পরাঙ্গম হবে। এখানে সদ্য নিয়োগকৃত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেমন হলো, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল বিষয় হচ্ছে কমিশনার নিয়োগের পদ্ধতি আরও বেশি জনসম্পৃক্ত হওয়া দরকার ছিল। দরকার ছিল কর্তৃত্ববাদী সরকার থেকে মুক্ত হওয়া বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে কিভাবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায় সে বিষয়গুলো যথেষ্ট বিবেচনায় রাখা।
যদি বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইন সংশোধন করা হয়, সে ক্ষেত্রে এই নিয়োগ প্রাপ্ত কমিশনের স্ট্যাটাস কী হবে, এটা একটা শুধু আইনি প্রশ্ন নয়, বরং এর সাথে জনবিছিন্ন এমন নিয়োগের বৈধতারও প্রশ্ন থেকে যায়।
নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট জনবল বা অবকাঠামোর অভাব। বর্তমানে, প্রায় ১৮ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় ১৩ কোটি ভোটার। এত বড় ভোটার সংখ্যা নিয়ে একদিনে নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব। তাই, সুশাসনের জন্য যেমন দরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যও দরকার রাষ্ট্রকে কতগুলো প্রাদেশিক ইউনিটে ভাগ করা দরকার। নির্বাচন কমিশনারের জনবল ঘাটতি রেখে, সরাসরি নির্বাহী বিভাগের লোককে সাময়িকভাবে নিয়োজিত করে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা দুরুহ। সংবিধান সংস্কারের যে প্রস্তাবগুলো আসছে, তার মধ্যে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অধীনে এনে জাতীয় নির্বাচনকে বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ও পেশাদার জনবল ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন পরিচালনার জন্য জনবলের পাশাপাশি দরকার, স্বনামধন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নির্বাচন চলাকালীন সময়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেওয়া ও মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের সুযোগ দেওয়া।
নির্বাচনের কার্যক্রম যত বেশি জনগণের, সাংবাদিকদের ও পেশাদার পর্যবেক্ষকদের নজরে থাকবে, তত বেশি নির্বাচনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। কিন্তু, পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া বা লোক দেখানো অপেশাদার পর্যবেক্ষকদের দিয়ে শুধু আগের মতো তামাশার নির্বাচন ছাড়া আর ও
ইনক্লুসিভ বা সকল বৃহত্তর দলকে নিয়ে জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশ বহুদিন দেখেনি। নির্বাচনকে মাথায় রেখে বিভিন্ন দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা এদেশের এক পুরনো খেলা। কোনও দলের কেউ যদি ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়, তখন তাদেরকে দেশের আইনে বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিচার নিশ্চিত করা উচিত। কিন্তু দলের নেতৃত্বদের অপরাধ বা দুর্নীতির দায়ে পুরো দলের নিবন্ধন বাতিল করার মধ্যে কোনও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই। সেই দলকে নৈতিকভাবে নিঃশেষ হতে দেওয়া সমীচীন। আবার, একই ভাবে শুধু নিয়ম-রক্ষার নির্বাচনের জন্য রাবার-স্ট্যাম্প মার্কা দলগুলো দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া নির্বাচনি স্পিরিটকে নষ্ট করে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য নির্বাচন কমিশন তৈরি হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। তারা তাদের নির্বাচন কমিশনার, প্রধান বিচারপতি সহ অন্যান্য সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য সরকারকে সুপারিশ করে। এই সাংবিধানিক কাউন্সিল এমনভাবে গঠিত যে সেখানে সরকার, বিরোধীদল ও অন্যান্য সংসদ সদস্যরা এই বডিতে থাকে। এটা একটা ব্যাল্যান্সড বডি, যেটা চাইলেই সরকার প্রভাবিত করতে পারে না। সাংবিধানিক ভাবে এমন একটা ইনক্লুসিভ কাউন্সিল গঠন করা বাংলাদেশে আবশ্যক, যেন সেখানে জনমতের প্রতিফলন ঘটে ও একটি সাম্যক আইনি কাঠামো তৈরি করা যায় যার অবশ্যই ন্যায্যতা ও বৈধতা থাকবে। অতীতের সরকারের মতো লোক দেখানো কোন কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই, শুধুমাত্র কমিশন নিয়োগের আইন সংশোধন করা যথেষ্ট নয়। সাংবিধানিক ভাবে বেশ কিছু বিষয়ের পরিবর্তন ছাড়া ক্রেডিবল বা নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ভয়েস/আআ/সূত্র: বাংলাট্রিবিউন।
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.