আবদুল আউওয়াল:
বিশ্ব জুড়ে মুসলিমরা নানাভাবে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও অবহেলিত। ভয়ে সবসময় জবুথবু হয়ে থাকে কখন জানি কোন বিপদ পেয়ে বসে। অথচ মুসলিমরা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিয়েছে সুদীর্ঘ ১৩শ বছর। ন্যায় ও শান্তির পথ দেখিয়ে গেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। পৃথিবীর দ্বিতীয় ধর্মাবলম্বী হিসেবে এখনো তারা ক্রমবর্ধমান। অথচ এখন অধঃপতনের চরম অবস্থায় পৌঁছে গেছে তারা। এর কারণ খুঁজতে গেলে প্রথমে আল কোরআনের সেই আয়াতের দিকেই দৃষ্টি যায় যেখানে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (বিধানকে) দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভেদ করো না।’ (সুরা আলে ইমরান ১০৩)
মুসলিম উম্মাহর সফলতার দুটি মূলমন্ত্র আয়াতে বিবৃত হয়েছে। আল্লাহর দেওয়া বিধান জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধারণ ও বিভেদের পথ পরিহার করা। দুটিই আমাদের বাস্তবজীবনে আজ চরমভাবে উপেক্ষিত। ব্যক্তিজীবনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন মানার চেষ্টা করলেও পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের বড় একটা অংশ জুড়ে তা হয় চরমভাবে লঙ্ঘিত। কিছু ক্ষেত্রে এমনভাবে বিজাতীয় রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠানের অনুকরণ করা হয়, দেখে বোঝার উপায়ই থাকে না আমরা মুসলিম নাকি অমুসলিম!
আমাদের সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি সবকিছুতে চলছে বিজাতীয় অনুকরণ বা আগ্রাসন। আর সেটা আমরা করছি জেনে কিংবা না জেনে, আনন্দে কিংবা বেদনায়। এটা হওয়া তো উচিত ছিল না। আল্লাহতায়ালা ইসলাম নামক যে নেয়ামত আমাদের দিয়েছেন, ইমান নামক যে দৌলত আমাদের প্রদান করছেন তার শুকরিয়া আদায় করার দরকার ছিল। যথাযথ তা মেনে বুঝে বাস্তবজীবনে প্রয়োগ ও অনুশীলনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমরা আল্লাহর বিধানের তোয়াক্কা করছি না। মানব রচিত মতবাদের দিকে ক্রমশ ঝুঁকছি। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে মুমিনরা তোমরা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না।’ (সুরা বাকারা ২০৮) কিন্তু আমরা আংশিক বা অপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করছি। সুবিধা মতো ইসলাম পালন করছি বা মান্য করছি। এ যেন আল্লাহর কিতাবের কিছু বিষয় স্বীকার করছি আর কিছু বিষয় অস্বীকার করছি। আমাদের এসব কর্ম আল্লাহর নেয়ামতের সঙ্গে অকৃজ্ঞতা ও তার বিধানের সঙ্গে ধৃষ্টতার শামিল। আর যারা তার নেয়ামতের অকৃতজ্ঞ হয় তাদের শাস্তি হয় ভয়াবহ। দুনিয়া ও পরকালে তাদের জীবন হয় লাঞ্ছনার।
অপরদিকে আল্লাহতায়ালা বলেছেন তোমরা বিভেদ কোরো না বিচ্ছিন্ন হয়ো না। কিন্তু আমরা আজ শতধা বিভক্ত-বিচ্ছিন্ন। ক্ষমতা, নেতৃত্ব বা ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে বিভেদ করে বহু দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। যে বিষয়ে রাসুল (সা.) আমাদের আগেই সতর্ক করে গিয়েছিলেন সে বিষয়টিই আজ আমাদের পেয়ে বসেছে। তিনি বলেছিলেন, ‘বনি ইসরায়েল ৭২ দলে বিভক্ত ছিল আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। সাবধান! জেনে রেখো, এদের মধ্যে একটি দল ছাড়া বাকিরা সব জাহান্নামে যাবে!’ (জামে তিরমিজি ২৬৪১)
এই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার ফলে আমাদের জীবনে নেমে এসেছে অপমান আর অপদস্থতা। হারিয়েছি পৃথিবীতে আমাদের আধিপত্য। এক সময় আরবের যাযাবর জাতি যাদের কোনো রাষ্ট্র ছিল না, ক্ষমতা ছিল না। উট চড়াতো, মেষের রাখালি করত। দুবেলা পেটপুরে খেতে পারলেই খুশিতে আত্মহারা হতো। মারামারি, কাটাকাটি, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অন্যায় কাজ করে যারা বেড়াত সেই আরবরা এক সময় ইসলামের ছায়ায় এসে বদলে গেল। অতীতের বিভেদ ভুলে এক হলো। অন্যায় ছেড়ে সোনার মানুষে পরিণত হলো।
তারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিল কীভাবে উন্নত আদর্শ অনুসরণের ফলে, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের বলয়ে থেকে একটি জাতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। উন্নতির শিখরে পৌঁছায়। বিশ্বনবীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে খুব অল্প দিনেই আরবরা তা করে দেখাল। সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর স্মরণ করো যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে (জাহেলি যুগে) তখন আল্লাহ তোমাদের প্রতি (নবী ও কোরআন পাঠিয়ে) অনুগ্রহ করেন। তিনি তোমাদের অন্তরসমূহ একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে দেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে!’ (সুরা আলে ইমরান ১০৩)
এই মিলনের ফলে বিশ্ব জুড়ে মুসলিমদের অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। খেলাফতে রাশেদা, খেলাফতে বনু উমাইয়া, খেলাফতে বনু আব্বাস, উপমহাদেশে মুঘল শাসন ও তুরস্কের ওসমানি সাম্রাজ্যের সোনালি ইতিহাসের কথা সবারই জানা। কিন্তু আফসোস! সেসব আজ যেন শুধুই অতীত।
বর্তমান পৃথিবীতে মুসলিমরা আজ দিশেহারা। নানা অপমান আর বঞ্চনার শিকার হয়ে তাদের বাঁচতে হচ্ছে। এসব অকৃতজ্ঞার ফল। আমাদের বদ আমলের পরিণতি। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে।’ (সুরা রাদ ১১)
আজ আমরা নিজেদের অবস্থা নিজেরাই পরিবর্তন করে ফেলেছি। প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছি। নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছি। পরস্পরের সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছি। দুনিয়ার ভোগবিলাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। ফলে আমাদের এই পরিণতি, এই দুরবস্থা। ঠিক যেন রাসুলের (সা.) বলে যাওয়া ভবিষ্যদ্বাণীর মতো। তিনি বলেছিলেন, ‘শিগগিরই মানুষ তোমাদের আক্রমণ করার জন্য আহ্বান জানাতে থাকবে, যেভাবে মানুষ তাদের সঙ্গে খাবার খাওয়ার জন্য একে অপরকে আহ্বান জানায়।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘সেদিন কি আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে এমন হবে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘‘না, তোমরা বরং সেদিন প্রচুর সংখ্যক হবে। কিন্তু তোমরা হবে বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া উপাদানের মতো। আর আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের ভয় দূর করে দেবেন এবং তোমাদের অন্তরে ‘আল-ওয়াহন’ ঢেলে দেবেন।” সাহাবিরা বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, ‘আল-ওয়াহন’ কী?” তিনি বললেন, ‘তা হলো দুনিয়ার ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।’ (সুনানে আবু দাউদ ৪২৯৭)
আজ আমরা ঠিক তেমনই। আমাদের কোনো শক্তি নেই। সক্ষমতা নেই। আমরা দুর্বল-অসহায়। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় নির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। জাতির প্রত্যেকটা সদস্যকে ভাবা উচিত আমরা কারা? আমাদের কী করা উচিত? নতুবা সামনে আরও ভয়াবহ দুরবস্থা হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সে লক্ষ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ একান্ত কাম্য।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.