নাহিদ হাসান:
পবিত্র কোরআনে যে কয়টি কাহিনি বারবার ফিরে এসেছে, সেগুলোর মধ্যে নবী মুসা (আ.)-এর কাহিনি সবচেয়ে বেশি। এটি শুধু কাহিনির দিক থেকে নয়, বরং পাঠকের হৃদয়কে দোলা দেওয়া, চিন্তা-চেতনায় আলোড়ন সৃষ্টি করা এবং আত্মশুদ্ধির অনুপ্রেরণার দিক থেকেও অতুলনীয়। সুরা বাকারা, আরাফ, তাহা, শুআরা ও কাসাস সুরায় মুসা (আ.)-এর জীবনের বিভিন্ন দিক বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। আবার সুরা রুম, দোখান, নাজিয়াতের মতো সুরাগুলোতে রয়েছে সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত।
মুসা (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইলের সন্তান। তার বংশধারা ইব্রাহিম (আ.)-এ গিয়ে মিশেছে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন এমন এক সময়ে, যখন মিসরের রাজা ফেরাউন তার সীমাহীন অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতা দিয়ে গোটা জাতিকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। ফেরাউন আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করত, নিজেকে প্রভু ঘোষণা করত এবং বনি ইসরাইলদের দাসত্বে পরিণত করেছিল। এই জাতিকে সে নিপীড়িত করে রাখত, ছেলেদের হত্যা করত আর মেয়েদের জীবিত রাখত শুধুই দাসত্বে ব্যবহারের জন্য।
ফেরাউনের এক জ্যোতিষী তাকে জানায়, বনি ইসরাইলদের মধ্য থেকে এক শিশু জন্ম নেবে, যে তার রাজত্বকে ধ্বংস করে দেবে। এর পরিণতিতে ফেরাউন হুকুম দেয়, বনি ইসরাইলের প্রতিটি ছেলে সন্তানকে জন্মমাত্রই হত্যা করতে হবে। এটা ছিল এক ভয়াবহ অধ্যায়। ঠিক এই সময়েই জন্মগ্রহণ করেন নবী মুসা (আ.)। তার মা এক ইমানদার নারী, আল্লাহ তার অন্তরে সাহস ও প্রেরণা দেন, যেন সে তার সন্তানকে একটি বাক্সে রেখে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। সন্তান হারানোর বেদনা, আবার অমানুষিক অত্যাচারের আশঙ্কা, এই দুইয়ের মধ্যে মুসা (আ.)-এর মা আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে সন্তানকে ভাসিয়ে দেন।
আল্লাহর কুদরতে সেই বাক্স ভেসে যায় ফেরাউনের প্রাসাদের কাছাকাছি এবং ফেরাউনের স্ত্রী সেই শিশুটিকে দেখে মুগ্ধ হন। শিশুটির প্রতি তার হৃদয়ে মায়া জন্মায়। তিনি ফেরাউনকে বলেন, ‘আসুন, এই শিশুকে আমরা লালন-পালন করি, আমাদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করি।’ ফেরাউন সম্মতি দেয়। এভাবে এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও আল্লাহ তার নবীকে ফেরাউনের ঘরেই নিরাপদ আশ্রয় দেন, যেটা ছিল ফেরাউনের ভবিষ্যতের ধ্বংসের বীজ।
শিশু মুসা (আ.) বুকের দুধ গ্রহণ করছিল না, অনেক দাইমা আসা-যাওয়ার পরও সে কোনো নারীর দুধ পান করছিল না। অবশেষে তার বোন ফেরাউনের প্রাসাদে প্রবেশ করে এবং এক দাইয়ের (নিজ মায়ের) কথা বলে, যার দুধ যে কোনো শিশু গ্রহণ করে। আল্লাহর কুদরতে মুসা (আ.) তার মায়ের দুধ গ্রহণ করেন। এভাবেই তার মা নিজের সন্তানকে ফিরে পান এবং দুধপানের সময় তিনি সন্তানের সঙ্গে থাকার সুযোগ পান। কয়েক বছর পর মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের প্রাসাদে ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং সেখানে তিনি বড় হতে থাকেন। প্রাসাদের রাজকীয় পরিবেশে বেড়ে উঠলেও তার ভেতর ছিল বনি ইসরাইলের প্রতি সহমর্মিতা ও সুবিচার। তার অন্তরে অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঘৃণা জন্মায়। একদিন শহরে হাঁটতে গিয়ে দেখতে পান, একজন ইসরাইলি ও একজন মিসরীয় কিবতি ঝগড়ায় লিপ্ত। কিবতি ছিল জালেম। ইসরাইলি ব্যক্তি মুসা (আ.)-এর সাহায্য চাইলে তিনি মিসরীয় ব্যক্তিকে আঘাত করেন, যার ফলে সে মারা যায়। এই অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের কারণে মুসা (আ.) আতঙ্কিত হন এবং তওবা করেন।
পরদিন আবার সেই ইসরাইলি ব্যক্তিকে ঝগড়ায় জড়িত দেখে মুসা (আ.) ক্ষুব্ধ হন এবং বলেন, ‘তুমি তো স্পষ্টই বিপথগামী।’ এদিকে আগের দিনের হত্যাকাণ্ড ফেরাউনের দরবারে পৌঁছে যায় এবং তাকে গ্রেপ্তার ও হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়। ঠিক তখনই একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি এসে তাকে সতর্ক করেন, ‘তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও।’ মুসা (আ.) রাতারাতি মিসর ত্যাগ করেন এবং প্রার্থনা করেন, ‘হে আমার প্রভু! আমাকে এই জালেম জাতি থেকে রক্ষা করুন।’
মুসা (আ.) নিরাশার চূড়ান্ত মুহূর্তে চলে যাওয়ার পথ ধরেন। পেটে ক্ষুধা, হাতে নেই কোনো সম্বল, অথচ মনেপ্রাণে ছিল আল্লাহর প্রতি আস্থা। তার গন্তব্য ছিল মাদইয়ান (বর্তমান জর্ডানের অংশবিশেষ)। সেখানে পৌঁছে যান দীর্ঘ সফরের পর। সেখানে একটি কূপের ধারে দেখতে পান কিছু মানুষ পানি তুলছে, আর এক কোণে দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুর্বলতা নয়, বরং লজ্জা ও পর্দার আদবেই তারা দূরে সরে রয়েছে। মুসা (আ.) তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, ‘আমরা পুরুষদের ভিড় কমার অপেক্ষা করি, আমাদের বৃদ্ধ পিতা নিজে আসতে পারেন না।’
এ কথা শুনে মুসা (আ.) তাদের জন্য পানি তুলে দেন। এরপর তিনি এক গাছতলায় আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর কাছে বলেন, ‘হে আমার প্রভু! আমি অভাবগ্রস্ত, তুমি যা নাজিল করো, আমি তারই মুখাপেক্ষী।’
এই দোয়ার পর ফলাফলও আসে দ্রুত। মেয়েরা বাড়ি ফিরে গিয়ে পিতাকে সব ঘটনা জানায়। তাদের পিতাও একজন নবী, তিনি শুয়াইব (আ.)। তিনি মুসা (আ.)-এর ঘটনা শুনে বিস্মিত হন এবং একজন কন্যাকে মুসা (আ.)-এর কাছে পাঠান। কন্যাটি শালীন ভঙ্গিতে মুসা (আ.)-কে আহ্বান জানায়, ‘আমার পিতা আপনাকে ডেকেছেন, আপনার উপকারের বিনিময়ে কিছু দিতে চান।’ এই আহ্বানে মুসা (আ.) সাড়া দেন এবং বৃদ্ধ পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার নিজের কাহিনি খুলে বলেন, শৈশব থেকে শুরু করে ঘটনাবলি, হত্যা, পলায়নসহ সব বলেন।
শুয়াইব (আ.) আশ্বস্ত করেন, ‘এখানে তুমি নিরাপদ, ভয় করো না।’ অতঃপর তার কন্যারা প্রস্তাব দেয়, ‘হে পিতা, আপনি তাকে চাকরি দিন। তিনি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।’ তিনি প্রস্তাব দেন, তুমি আমার মেয়েদের একজনকে বিয়ে করো, এর বিনিময়ে আট বছর আমার অধীনে চাকরি করবে। যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ করো, সেটি তোমার পক্ষ থেকে উদারতা। মুসা (আ.) সম্মতি দেন। এরপর শুরু হয় এক নবপর্যায়ের জীবন সংসার, পরিশ্রম, আত্মশুদ্ধি ও নবুয়তের প্রস্তুতি।
দশ বছর শেষে মুসা (আ.) স্ত্রীকে নিয়ে মিসরে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। পথে এক অন্ধকার রাতে তিনি আগুনের আলো দেখতে পান, সেটি ছিল তুর পাহাড়ের কাছে। আগুনের কাছে গেলে তিনি ডাক শুনতে পান, ‘হে মুসা! আমি তোমার প্রতিপালক।’ এখানেই শুরু হয় তার নবুয়তি জীবনের প্রকৃত অধ্যায়। আল্লাহ তাকে দায়িত্ব দেন, ফেরাউনের কাছে গিয়ে তাকে আল্লাহর পথে ডাক দেওয়ার এবং বনি ইসরাইলকে মুক্ত করার।
মুসা (আ.) আল্লাহর দরবারে নিজের ভাষাগত দুর্বলতা, ভয় এবং ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কথা বলেন। আল্লাহ তাকে সান্ত্বনা দেন, শক্তি দেন এবং ভাই হারুন (আ.)-কে তার সহকারী বানিয়ে দেন। মুসা (আ.) ফেরাউনের দরবারে গিয়ে বলেন, ‘আমি আল্লাহর প্রেরিত একজন রাসুল। তোমার সীমালঙ্ঘন বন্ধ করো, বনি ইসরাইলকে মুক্ত করো।’ ফেরাউন শুরুতে উপহাস করে, তারপর ক্রমে শত্রুতা বাড়ায়।
এরপর শুরু হয় ফেরাউনের সঙ্গে দীর্ঘ দ্বন্দ্ব। মুসা (আ.) অলৌকিক মুজিজা প্রদর্শন করেন, লাঠি সাপ হয়ে যায়। একের পর এক বিপর্যয় আসে ফেরাউনের জাতির ওপর, কিন্তু অহংকারী এই শাসক বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করে।
শেষে আল্লাহর আদেশে মুসা (আ.) বনি ইসরাইলকে নিয়ে রাতের আঁধারে মিসর ত্যাগ করেন। ফেরাউন সৈন্যদল নিয়ে তাড়া করে। সাগরের কিনারায় পৌঁছে মুসা (আ.) বলেন, ‘আমার প্রভু আমার সঙ্গে আছেন।’ আল্লাহ সাগরকে দ্বিখণ্ডিত করে দেন। বনি ইসরাইল পার হয়ে যায়, আর ফেরাউনের বাহিনী ডুবে যায়। এভাবে এক জালেমের পতন হয়।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.