নাহিদ হাসান:
তারুণ্য ও যৌবন মানুষের জীবনের সোনালি অধ্যায়। এটি এমন এক সময়, যখন দেহ ও মনে থাকে পূর্ণ শক্তি, উদ্যম ও কর্মক্ষমতা। এই শক্তি যদি সঠিক পথে ব্যবহৃত হয়, তবে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব। আর অপব্যবহার হলে তা ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই ইসলাম যৌবনকালকে শুধু জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় আখ্যা দেয়নি, বরং এটাকে মহান আল্লাহর বিশেষ দান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই বয়সে মানুষ যেমন শারীরিকভাবে সক্ষম থাকে, তেমনি মানসিক দৃঢ়তা ও চিন্তার গভীরতাও থাকে প্রবল।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা মানবজীবনের ধাপসমূহ উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি দুর্বলতার পর দিয়েছেন শক্তি, আর শক্তির পর আবার দিয়েছেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। এর দ্বারা বোঝা যায়, যৌবনকাল ক্ষণস্থায়ী, তাই এটিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যুগে যুগে পরিবর্তনের অগ্রদূত ছিলেন তরুণরা। নবী-রাসুলরা, সাহাবায়ে কেরাম, আল্লাহর প্রিয় বান্দারা তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো করেছেন যৌবনের উচ্ছল সময়ে। ইসলাম তারুণ্য ও যৌবনকে বিশেষ মূল্য দিয়ে থাকে। কোরআন-হাদিসের আলোকে তারুণ্যের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো।
তারুণ্য আল্লাহর দান : তারুণ্য ও যৌবন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। তাই তারুণ্যের মূল্যায়ন ও যথার্থ ব্যবহার আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি, শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য।’ (সুরা রুম ৫৪)
নবীদের বৈশিষ্ট্য : মহান আল্লাহ দ্বীন প্রচারের গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন নবী-রাসুলদের। তাদের সবাই ছিলেন যুবক। বার্ধক্যে উপনীত কাউকে তিনি নবুয়তের দায়িত্ব দেননি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহ যুবক ছাড়া কাউকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেননি।’ (আহাদিসুল মুখতারাহ ১৬/১০)
অন্যায়ের প্রতিবাদে তারুণ্য : তরুণ ও যুবকরা যুগে যুগে অন্যায়ের প্রতিবাদে দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করেছে। পবিত্র কোরআনে এমন একদল যুবকের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘তারা ছিল কয়েকজন যুবক, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি ইমান এনেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম। আর আমি তাদের চিত্ত দৃঢ় করে দিলাম, তারা যখন উঠে দাঁড়াল, তখন বলল, আমাদের প্রতিপালক আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক। আমরা কখনই তার পরিবর্তে অন্য কোনো ইলাহকে আহ্বান করব না। যদি করে বসি, তবে তা অতিশয় গর্হিত হবে।’ (সুরা কাহাফ ১৩-১৪)
জাতির বিবেক জাগ্রত করে : মহান আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রশংসা করে বলেছেন, ‘ইব্রাহিম ও তার সঙ্গীদের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সুরা মুমতাহিনা/৪) পবিত্র কোরআনে ইব্রাহিম (আ.)-এর যেসব গুণ বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর একটি হলো স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমগ্র জাতির বিবেক জাগিয়ে দেওয়া। ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ কেউ বলল, এক যুবককে তাদের সমালোচনা করতে শুনেছি, তার নাম ইব্রাহিম। তারা বলল, তাকে উপস্থিত করো লোকসম্মুখে, যাতে তারা প্রত্যক্ষ করতে পারে। তারা বলল, হে ইব্রাহিম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলোর প্রতি এরূপ করেছ? সে বলল, বরং তাদের এই প্রধান, সেই তো এটা করেছে, তাদের জিজ্ঞাসা করো যদি তারা কথা বলতে পারে। তখন তারা মনে মনে চিন্তা করে দেখল এবং একে অপরকে বলতে লাগল, তোমরাই তো সীমা লঙ্ঘনকারী?’ (সুরা আম্বিয়া ৬০-৬৪)
পৃথিবীর প্রথম আত্মত্যাগ : পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম অন্যায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন হাবিল। কাবিল তাকে হিংসার বশবর্তী হয়ে হত্যা করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের থেকে (কোরবানি) কবুল করে থাকেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হও, তবে আমি তোমাকে পাল্টা হত্যা করতে উদ্যত হব না। কেননা আমি জগৎগুলোর প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ (সুরা মায়িদা ২৭-২৮)
সত্যের আহ্বানে সাড়া : মহানবী (সা.) যখন মহাসত্যের আহ্বান নিয়ে আসেন, তখন মক্কার যুবকরাই সর্বপ্রথম সাড়া দেন। প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবিদের বেশির ভাগই ছিলেন বয়সে যুবক। যেমন প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী আবু বকর (রা.)-এর বয়স ছিল ৩৭ বছর, ওসমান (রা.)-এর বয়স ছিল ৩৪ বছর, ওমর (রা.)-এর বয়স ছিল ২৭ বছর, আলি (রা.)-এর বয়স ছিল ১০ বছর।
নবীজির যুগে রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ : রাসুলুল্লাহ (সা.) যুবক ও তরুণদের মেধা, যোগ্যতা ও বিচক্ষণতার মূল্যায়ন করতেন। তিনি বিভিন্ন সময় তরুণ ও যুবকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন। যেমন ইফকের মতো গুরুতর বিষয়ে তিনি ওসামা বিন জায়েদ (রা.)-এর মতো কিশোরের সঙ্গে পরামর্শ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাকে রোমানদের বিরুদ্ধে প্রেরিত বাহিনীর সেনানায়ক নিযুক্ত করেন। (সহিহ বুখারি) আত্তাব ইবনে উসাইদ (রা.)-কে মক্কার গভর্নর নিযুক্ত করেন। মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.)-কে মদিনায় শিক্ষক ও ইসলাম প্রচারক হিসেবে প্রেরণ করেন। এ ছাড়া আলি (রা.)-কে ইয়েমেনের প্রশাসক এবং ওসমান ইবনে আবিল আস (রা.)-কে তায়েফের প্রশাসক নিযুক্ত করেন।
তরুণ হত্যাকারীদের প্রতি অভিশাপ : বিরে মাউনার হত্যাকাণ্ড ইসলামের ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক ঘটনা। এই ঘটনায় ৭০ জন যুবক আনসার সাহাবিকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। যারা ছিল কোরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত। মহানবী (সা.) এই ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং হত্যাকারীদের প্রতি ধারাবাহিকভাবে অভিশাপ করেন। তিনি ১৫ দিন (মতান্তরে এক মাস) পর্যন্ত প্রতিদিন ফজরের নামাজে তাদের প্রতি অভিশাপ করেন। (মুসনাদে আহমদ)
তারুণ্যের শৃঙ্খলা : তরুণ ও যুবকদের কাজের সৌন্দর্য শৃঙ্খলা। শৃঙ্খলা থাকলে তাদের কাজ অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়। মালেক বিন হুওয়াইরিস (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, তারা সমবয়সী কয়েকজন যুবক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আসেন। তারা সেখানে ২০ রাত অবস্থান করেন। তিনি তাদের দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো শিক্ষা দান করে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের দ্বীনপ্রচারের নির্দেশ দেন এবং দ্বীনি কার্যক্রমে শৃঙ্খলা রক্ষার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘নামাজের সময় হলে তোমাদের একজন আজান দেবে। তবে বয়সে যে সবার বড় সে ইমামতি করবে।’ (সহিহ মুসলিম)
তরুণদের গড়ে তোলা : ইসলাম যুবকদের আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত করতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মহানবী (সা.) ও সাহাবিরা তরুণদের শিক্ষাদীক্ষায় অত্যন্ত মনোযোগী ছিলেন। আবু সাইদ খুদরি (রা.) কোনো মুসলিম যুবককে দেখলে খুশি হয়ে বলতেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অসিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার এবং তোমাদের হাদিস বোঝাবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও হাদিসের ধারক তথা ইলমের উত্তরাধিকারী।’ (শারফু আসহাবিল হাদিস ১২)
যৌবনকালের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ : ইসলাম যেমন তারুণ্য ও যৌবনকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে, তেমনি পরকালেও যৌবনের ব্যাপারে তাদের বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মহানবী (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মানুষকে নিজ স্থান থেকে এক কদম নড়তে দেওয়া হবে না। এক. সে তার জীবনকাল কীভাবে অতিবাহিত করেছে। দুই. যৌবনকাল কোথায় ব্যয় করেছে। তিন. ধন-সম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছে। চার. কোন পথে তা ব্যয় করেছে। ৫. সে দ্বীনের কতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে এবং অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী সে আমল করেছে কি না। (সুনানে তিরমিজি)
যে জাতি তারুণ্যের শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে, তারা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে। আর যে জাতি এই শক্তিকে অবহেলা করে, তারা হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে। এজন্য ইসলামের নির্দেশনা হলো, তারুণ্যের সময়কে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও মানবতার সেবায় ব্যবহার করা, যাতে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে সাফল্য লাভ করা যায়।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.