আইনাল হক:
মানবসভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে অসংখ্য সম্রাট, সমরনায়ক ও দার্শনিক রাষ্ট্রচিন্তক জন্ম নিয়েছেন। কেউ যুদ্ধের মাধ্যমে ভূখণ্ড জয় করেছেন, কেউ-বা নতুন মতবাদ প্রচার করেছেন। কিন্তু একজন ব্যক্তিত্বই আছেন, যিনি একইসঙ্গে ছিলেন আধ্যাত্মিক নেতা, নৈতিক শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক ও রাষ্ট্রপ্রধান, তিনি হলেন সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এমন এক রাষ্ট্র, যা শুধু সমকালীন আরব সমাজকেই নয়, ভবিষ্যতের মানবসমাজকেও ন্যায়, সাম্য ও মানবিকতার এক অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত উপহার দিয়েছে।
নবীজির রাষ্ট্র পরিচালনা কোনো কল্পিত নীতি বা সামরিক দমননীতির ফসল ছিল না। বরং তা ছিল আল্লাহপ্রদত্ত নির্দেশনা ও বাস্তবজীবনের প্রজ্ঞার সমন্বিত প্রয়োগ। মদিনার ভূমিতে গড়ে ওঠা ইসলামি রাষ্ট্র মূলত কোরআনের শিক্ষা, ন্যায়পরায়ণতা, পরামর্শভিত্তিক শাসন, জনগণের অধিকার ও জবাবদিহির এক অনন্য মডেল। ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন করে তিনি বিশ্ব ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধানের ধারণা উপহার দেন, যেখানে মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার স্পষ্টভাবে স্বীকৃত হয়েছিল।
রাসুল (সা.)-এর রাষ্ট্রচিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি এবং মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। তিনি শাসক হয়েও প্রজার মতো জীবনযাপন করতেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকেও দীন-দরিদ্রের পাশে দাঁড়াতেন। মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে প্রশাসনিক কাঠামো, যেখানে সাহাবায়ে কেরাম দায়িত্ব পালন করতেন সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। তিনি প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে নৈতিকতা, জবাবদিহি ও পরহেজগারির ওপর জোর দেন।
জীবন ও জগতের খুঁটিনাটি থেকে বৃহৎ সব ক্ষেত্রে রাসুল (সা.) ছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ। তেমনি একটি ভৌগোলিক সীমারেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবেও তিনি মানবেতিহাসের পাতায় আপন মহিমায় চিরভাস্বর। আজকের পৃথিবীর কোথাও সেই রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ নেই বলেই বিশ্ব আজ শত অশান্তি ও নানা নৈরাজ্যের শিকার।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনার ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সর্বপ্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। মদিনাকে তিনি এমন কল্যাণমুখর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে যেমন আসীন ছিলেন তিনি, তেমনি জনসাধারণের হৃদয়ের মণিকোঠায়ও ছিল তার সপ্রতিভ অবস্থান।
মহানবী (সা.)-এর ঐতিহাসিক একটি সাফল্য হলো, তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি লিখিত শাসনতন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। ‘মদিনা সনদ’ নামে সাত চল্লিশটি ধারা সংবলিত এ ধরনের মানবিক সমঝোতামূলক শাসনতন্ত্র প্রয়োগিকভাবে আর কেউ উপহার দিতে পারেনি। তিনি নীতি ও আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। আল্লাহর কোরআন হলো সে আদর্শের মূল ভিত্তি। সে হিসেবে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি এটিই তার আদর্শ রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
তিনি তার রাষ্ট্রে ছয়টি মূলনীতি নির্ধারণ করেন। সেগুলো হলো এক. আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য সব আনুগত্যের ঊর্ধ্বে। দুই. সব দায়িত্বপূর্ণ ও প্রশাসনিক পদে মুসলিম নিযুক্ত হওয়া আবশ্যক। তিন. ইসলামি সরকারের আনুগত্য জনগণের অপরিহার্য। চার. সরকারের সমালোচনার অধিকার জনগণের থাকবে। পাঁচ. রাষ্ট্রের সব আইন ও বিধানের মানদণ্ড হবে ইসলামি শরিয়ত। ছয়. বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তার রাসুলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
এসব মূলনীতির ভিত্তিতে মহানবী (সা.) মদিনার আর্থসামাজিক ও প্রভূত উন্নয়নে এক বৈপ্লবিক জোয়ার সাধিত করেছিলেন। এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে তিনি আদর্শ ও ইনসাফের এক অনন্য ফল্গুধারা বইয়ে দেন। মক্কাবিজয় পরবর্তী সময়ে আরব উপদ্বীপের হাজার হাজার বর্গমাইল এলাকা তার অধীনে চলে আসে।
গোটা ‘জাজিরাতুল আরব’ বা আরব উপদ্বীপের একচ্ছত্র আধিপতি হিসেবে তিনি মদিনাকে কেন্দ্রীয় রাজধানী করে সমগ্র শাসন এলাকা দশটি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্রদেশে গভর্নর নিযুক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার-নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। প্রত্যেক গভর্নরের নিযুক্তি ছিল বিশেষ যোগ্যতা, সৎনিষ্ঠা ও পরহেজগারির ভিত্তিতে। নিযুক্তিকালে শপথ পাঠ করানোসহ গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দেওয়া হতো। হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)-কে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় তিনি যেসব কথা বলেছিলেন তা মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য সবসময় চর্চিত।
মহানবী (সা.)-এর রাষ্ট্র ছিল শুরা বা পরামর্শভিত্তিক রাষ্ট্র। তার রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার বিশেষ করে অমুসলিমদের অধিকার নিশ্চিত ছিল। পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে রাসুল (সা.) সমঝোতা-শৃঙ্খলা, মৈত্রী-উদারতা ও ক্ষমার মূর্তপ্রতীক ছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিন তার উদার ক্ষমা ঘোষণা বিশ্বের যেকোনো চিন্তাবিদকে আলোড়িত করে। তিনি মাঠে-ময়দানে ছিলেন একজন তুখোড় সমরবিদ ও মানবেতিহাসের সর্বাপেক্ষা মানবতাবাদী রাষ্ট্রনায়ক। প্রতিহিংসামূলক হত্যা, যুদ্ধে বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ ও শিশুহত্যা তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। সম্পদ অর্জন ও বহনের ব্যাপারে শরিয়তের নীতিমালাই ছিল তার সর্বোত্তম আদর্শ।
জগতের অতুলনীয় প্রভাবশালী রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তার চলাফেরায় সাদাসিধে ভাব সদা স্পষ্ট ছিল। জীবনে তিনি কখনো দুই বেলা পেট পুরে খাননি। শক্ত তোশক ও চাটাইয়ের বালিশ ছিল তার চিরসম্বল। দিনে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন আর রাতে প্রভুর দরবারে অশ্রু বিসর্জন দিতেন।
আট লাখ বর্গমাইলের এই মহান রাষ্ট্রপ্রধান মহানবী (সা.) চিরবিদায় কালে রেখে গিয়েছিলেন কিছু গৃহস্থালি ও প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধাস্ত্র। আর রেখে গিয়েছিলেন একটি পূর্ণাঙ্গ নিখুঁত কালজয়ী ও সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ।
লেখক : মাদ্রাসাশিক্ষক ও প্রবন্ধকার
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.