নাহিদ হাসান:
বর্তমান বিশ্বে তথ্যপ্রবাহ মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বাস্তবতা। প্রতিটি মানুষকে তাদের নাগরিক অধিকার হিসেবে তথ্যের অধিকার, সমাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে জানা থাকা আবশ্যক। কারণ তথ্যের প্রাপ্যতা ছাড়া ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। ইসলামের আলোকে বিষয়টি আরও গভীর তাৎপর্য বহন করে। কোরআনে মহান আল্লাহ বারবার বলেছেন, মানুষকে জ্ঞানার্জন করতে হবে, সত্য জানতে হবে এবং মিথ্যা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রথম ওহি ‘ইকরা’ মানুষকে পড়া ও জানার শিক্ষা দিয়েছে। জ্ঞান ও তথ্য ইসলামি সভ্যতার প্রাণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জ্ঞানকে এমনভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন যে, তিনি বলেছেন, জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ।
তথ্যের অধিকার মানে হচ্ছে, মানুষ তার জীবন ও সমাজ সম্পর্কিত বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত হবে, সঠিক ও ভুলের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারবে। ইসলামে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার পূর্বশর্ত হলো সত্য জানা। যদি তথ্য গোপন করা হয় বা বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়, তবে সমাজে বিভ্রান্তি, অন্যায় ও দুর্নীতি বিস্তার লাভ করে। এ জন্যই কোরআনে মিথ্যা গোপন বা বিকৃত করাকে বড় পাপ বলা হয়েছে।
ইসলাম তথ্যপ্রাপ্তির সঙ্গে দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। সব তথ্য সবার কাছে প্রকাশযোগ্য নয়। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার প্রশ্নে সংযম প্রয়োজন। তবে সমাজে যে তথ্য জনকল্যাণে জরুরি, তা গোপন রাখা ইসলাম অনুমোদন করে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান গোপন করে, তাকে কেয়ামতের দিন আগুনের শৃঙ্খল পরানো হবে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ)
তথ্যের অধিকার কেবল রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বচ্ছতার জন্য নয়, বরং এটি মানুষের আত্মিক বিকাশেরও পথ খুলে দেয়। জ্ঞান ও তথ্য মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দেয়। তাই মুসলিম সমাজের উচিত কোরআন-সুন্নাহর শিক্ষা থেকে প্রেরণা নিয়ে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকে সমর্থন করা এবং স্বচ্ছ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
আর বর্তমানে হাতের মুঠোয় প্রযুক্তি। যেকোনো তথ্য মুহূর্তে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খুব সহজে করা যায় ভাবের আদান-প্রদান ও তথ্যের বিনিময়। ফলে মানুষের জীবনযাত্রা হয়েছে সহজ ও সাবলীল। তবে একই সঙ্গে তথ্যের অবাধ প্রবাহ মানুষকে তুমুল বিভ্রান্ত করছে। প্রতিনিয়ত বিপদে ফেলছে। ব্যক্তিগত তথ্য কিংবা অন্যের যেকোনো তথ্য সুরক্ষার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা অত্যন্ত কঠোর। তথ্য প্রকাশ করে মানুষকে বিপদে ফেলা বা গুজব ছড়ানো গুনাহ।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয়ই কতক ধারণা গুনাহ। তোমরা অন্যের দোষ খোঁজাখুঁজি করো না, একে অন্যের অনুপস্থিতিতে দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো সেটাকে ঘৃণাই করে থাকো।’ (সুরা হুজুরাত ১২)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৪৩নং ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কখনোই অন্য এক ব্যক্তির গোপনীয়তা, পারিবারিক বিষয়, বাসস্থান বা যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি আত্মসম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারবে না। ইসলামে ব্যক্তিগত ও অন্যের তথ্য সুরক্ষা করা ইমানি দায়িত্ব। মানুষের দোষ খুঁজে বলে বেড়ানো পাপ। এতে মানুষের জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তুমি যদি মানুষের গোপনীয় বিষয় জানার জন্য পেছনে লাগো, তবে তাদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে কিংবা অন্তত বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে।’ (আবু দাউদ ৪৮৮৮)
ব্যক্তিজীবনের কোনো তথ্যই মূল্যহীন নয়, বরং সময়ের পরিক্রমায় অতি সামান্য তথ্যও আপনাকে ঘায়েল করার গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হতে পারে। তাই সব সময় নিজের গোপনীয় বিষয় সংরক্ষণে সতর্ক থাকতে হবে। অন্যের গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করা যাবে না। কারও গোপনীয়তা নষ্ট হয়, এমন কাজে জড়ানো যাবে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি, তারা যেন তোমাদের কক্ষে প্রবেশ করতে তিন সময়ে অনুমতি গ্রহণ করে। ফজরের নামাজের পূর্বে, দুপুরে যখন তোমরা তোমাদের পোশাক খুলে রাখো (বিশ্রাম নাও) এবং এশার নামাজের পর। এই তিনটি তোমাদের গোপনীয়তার সময়। এই তিন সময়ের পর তোমাদের এবং তাদের কোনো দোষ নেই। তোমাদের একে অন্যের কাছে যাতায়াত করতেই হয়। এভাবে আল্লাহ তোমাদের উদ্দেশে তার আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা নুর ৫৮)
কারও গোপনীয় বিষয় সন্ধান করা থেকে সতর্ক করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে লোকজন! যারা মুখে ইমান এনেছ, কিন্তু এখনো ইমান তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলিমদের গোপনীয় বিষয় খুঁজে বেড়িও না। যে মুসলিমদের দোষ-ত্রুটি তালাশ করে বেড়াবে আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটির অন্বেষণে লেগে যাবেন। আর আল্লাহ যার ত্রুটি তালাশ করেন তাকে তার ঘরের মধ্যে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন।’ (আবু দাউদ ৪৮৮০)
সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও অপরাধীর সঠিক শাস্তির বিধানের জন্য রাষ্ট্রের যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের কাছে অপরাধীর সব তথ্য প্রকাশ করার জন্য ইসলামে নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের কাছে নিরাপত্তার কিংবা ভয়ের কোনো সংবাদ আসে, তখন তারা তা রটিয়ে দেয়। যদি তারা তা রাসুলের কিংবা তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের গোচরে আনত, তবে তাদের মধ্য থেকে তথ্যানুসন্ধানীরা প্রকৃত তথ্য জেনে নিত। যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর দয়া ও করুণা না থাকত, তবে তোমাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করত।’ (সুরা নিসা ৮৩)
আজকাল প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় আমরা খুব সহজে নানাবিধ তথ্য পাই। তথ্য পেলেই প্রথমে যাচাই করতে হবে। এর সত্যতা নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বসো। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়।’ (সুরা হুজুরাত ৬)
যাচাই না করে সংবাদ প্রচার করা নিজেকে মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচিত করার বহিঃপ্রকাশ। তথ্য পেলেই যাচাই করা ছাড়া প্রচারের নিন্দা করেছেন আল্লাহতায়ালা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তরের প্রতিটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল ৩৬)
আধুনিক যুগে তথ্যপ্রাপ্তি যেমন মানবাধিকার ও সামাজিক স্বচ্ছতার জন্য অপরিহার্য, তেমনি ইসলামে এটি একটি ইমানি দায়িত্ব। তবে ইসলাম তথ্যপ্রাপ্তির স্বাধীনতার সঙ্গে সঠিক ব্যবহার ও নৈতিকতার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। কারণ তথ্য হতে হবে সত্যভিত্তিক, উপকারী ও জনকল্যাণমূলক। গোপনীয়তা ভঙ্গ, গুজব ছড়ানো বা মিথ্যা প্রচার করার মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তথ্যের সঠিক প্রয়োগ মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে এবং মিথ্যা ও বিভ্রান্তির অন্ধকার থেকে মুক্তি দেয়। মুসলিম সমাজের উচিত তথ্যপ্রাপ্তি ও প্রচারের ক্ষেত্রে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মেনে একটি ন্যায়ভিত্তিক, স্বচ্ছ ও শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া।
লেখক : মাদ্রাসাশিক্ষক ও প্রবন্ধকার/ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.