মুফতি মাহবুব হাসান:
কোরআনে শতাধিকবার হৃদয়ের কথা বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ হৃদয়কে ইমান, চিন্তা, অনুভূতি ও নৈতিকতার আসন হিসেবে বানিয়েছেন। তাই কোরআনে যখন কলব বা হৃদয়ের কথা বলা হয়, তখন সেটার অর্থ দাঁড়ায় মানুষের ভেতরের সেই নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র, যেখান থেকে আচরণ, নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্তের জন্ম হয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে হৃদয়ের গুরুত্ব অনন্যভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের দেহে এক টুকরা গোশত আছে, সেটি ভালো হলে পুরো দেহ ভালো হয়। আর সেটি নষ্ট হলে পুরো দেহ নষ্ট হয়ে যায়। আর সেটিই হলো কলব বা হৃদয়। (সহিহ মুসলিম) এই হাদিস প্রমাণ করে, মানুষের চরিত্র, আমল ও আচার-আচরণের শেকড় হৃদয়ে প্রোথিত। তবে বুদ্ধিমত্তার আধার হৃদয় নাকি মস্কিষ্ক, এটা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে মস্তিষ্কই বুদ্ধিমত্তার আধার। ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এরে মতে হৃদয়ই বুদ্ধিমত্তার আধার। তবে সর্বশেষ কথা হলো, এই দুটি একটি অপরটির পরিপূরক।
কোরআনের আয়াতগুলোতে হৃদয়ের নানা অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। কখনো বলা হয়েছে সুস্থ, প্রশান্ত ও বিনম্র হৃদয়ের কথা। আবার কখনো বলা হয়েছে অসুস্থ, অন্ধ ও মহরকৃত হৃদয়ের কথা। এতে স্পষ্ট হয়, মহান আল্লাহ মানুষের হৃদয়কে বহুমুখী সম্ভাবনার অধিকারী করে সৃষ্টি করেছেন। এটি চাইলে হতে পারে সত্যের আলোয় আলোকিত, আবার চাইলে মিথ্যার আঁধারে নিমজ্জিত। মানুষের অন্তরের এই পরিবর্তনশীলতা তার ভাগ্যকেও প্রভাবিত করে।
কোরআনে হৃদয়ের ইতিবাচক ও নেতিবাচক সব দিক চিত্রিত করা হয়েছে, যেন মানুষ নিজের অবস্থান চিনতে পারে এবং কলুষিত অন্তরকে পবিত্র করার চেষ্টা চালায়। কেননা হৃদয় যদি পরিশুদ্ধ হয় তবে তার প্রতিফল পড়বে কর্মে, সমাজে ও দুনিয়া-আখেরাতে। আর যদি হৃদয় অসুস্থ হয়, তবে তার প্রতিক্রিয়া গোটা জীবনে ছড়িয়ে পড়ে। কোরআনের এই বর্ণনা পাঠককে শুধু চিন্তায় নিমগ্নই করে না, বরং আমলে উদ্বুদ্ধ করে। কোরআনে বিভিন্ন ধরনের যে হৃদয়ের কথা বলা হয়েছে তা উল্লেখ করা হলো।
অনুগত হৃদয় : বিনম্র হৃদয় আল্লাহর প্রতি পূর্ণরূপে অর্পিত। আল্লাহর বিধিবিধানে পূর্ণরূপে বিশ্বাসী। আর সে হৃদয় শয়তানের কুমন্ত্রণায় কর্ণপাত করে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তারা যেন জেনে নেয় এটাই (অর্থাৎ এ কালামই) সত্য, যা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে। অতঃপর তারা যেন তাতে ইমান আনে এবং তাদের হৃদয় যেন তার প্রতি অনুগত হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জন্য সরল পথের হেদায়াতদাতা।’ (সুরা হজ ৫৪)
সুস্থ হৃদয় : সুস্থ হৃদয় সব ধরনের খারাবি থেকে মুক্ত থাকে। সব ধরনের কুফর-শিরক ও বেদয়াত থেকে পবিত্র থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তবে যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে সুস্থ হৃদয় নিয়ে সে মুক্তি পাবে।’ (সুরা
শুয়ারা ৮৯)
বিনীত হৃদয় : শয়নে-স্বপনে সর্বাবস্থায় যে হৃদয় আল্লাহর জন্য বিনীত থাকে, আল্লাহমুখী থেকে আল্লাহকে স্মরণ করে তা হলো বিনীত হৃদয়। আল্লাহ বলেন, ‘যে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে তাকে না দেখেই এবং আল্লাহর দিকে বিনীত হৃদয় নিয়ে উপস্থিত হয়।’ (সুরা কাফ ৩৩)
ভীতসন্ত্রস্ত হৃদয় : যে হৃদয় আল্লাহর ভয়ে সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। অল্পস্বল্প যেসব আমল করা হয়, সেসবের ব্যাপারে ভয় থাকে যে আল্লাহ কবুল করবেন কিনা। আল্লাহ বলেন, ‘যারা যে কোনো কাজই করে তা করার সময় তাদের হৃদয় এই ভয়ে ভীত থাকে যে তাদের নিজ প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে।’ (সুরা মুমিনুন ৬০)
মুত্তাকি হৃদয় : যে হৃদয় আল্লাহর ভয়ে সর্বদা তাকওয়ার পথে চলে। আল্লাহ বলেন, ‘এটাই হলো আল্লাহর বিধান, যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা হৃদয়ের তাকওয়া থেকেই।’ (সুরা হজ ৩২)
প্রশান্ত হৃদয় : যে হৃদয় একমাত্র আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে প্রশান্তি অনুভব করে এবং পুলকিত হয়। যখনই আল্লাহর জিকির করে তার হৃদয় শান্ত ও প্রশান্ত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তারা সেসব লোক, যারা ইমান এনেছে এবং যাদের হৃদয় আল্লাহর জিকিরে প্রশান্তি লাভ করে। স্মরণ রেখো! শুধু আল্লাহর জিকিরেই হৃদয় প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ ২৮)
হেদায়াতপ্রাপ্ত হৃদয় : যে হৃদয় আল্লাহর পথে পরিচালিত। নিশ্চিন্ত মনে সব কিছু আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেয়। আল্লাহর সব কিছুতে সন্তুষ্ট থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘কোনো মসিবত আল্লাহর হুকুম ছাড়া আসে না। যে কেউ আল্লাহর প্রতি ইমান আনে, আল্লাহ তার হৃদয়কে হেদায়াত দান করেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞাত।’ (সুরা তাগাবুন ১১)
প্রাণবন্ত হৃদয় : যে সদা সজাগ ও সচল থাকে আল্লাহর নিদর্শনাবলি উপলব্ধি করে। কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই এর ভেতর এমন ব্যক্তির জন্য উপদেশ রয়েছে, যার আছে হৃদয় কিংবা যে মনোযোগ দিয়ে কর্ণপাত করে।’ (সুরা কাফ ৩৭)
অসুস্থ হৃদয় : যে হৃদয়ে নানা সন্দেহের দানা বাসা বেঁধে আছে, পাপাচার ও প্রভৃতির অনুসরণে মরিয়া যে হৃদয় তা অসুস্থ। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও। তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করো, তাহলে পর পুরুষের সঙ্গে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, যাতে যার হৃদয়ে ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়। তোমরা সংগত কথা বলবে।’ (সুরা আহজাব ৩২)
অন্ধ হৃদয় : যে হৃদয় ভালো-মন্দ নিরূপণ করতে পারে না। সব কিছু স্পষ্ট হলেও সে থাকে অন্ধের মতো। মহান আল্লাহ বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে চোখ অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় সেই হৃদয়, যা বক্ষদেশে বিরাজ করে।’ (সুরা হজ ৪৬)
উদাসীন হৃদয় : যে হৃদয় মহান আল্লাহর বিভিন্ন বিধানের ব্যাপারে উদাসীন। অন্যদিকে দুনিয়ার প্রতি সদা সজাগ। প্রবৃত্তির অনুসরণে মত্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ওই ব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার অন্তরকে আমি আমার জিকির থেকে উদাসীন করে দিয়েছি এবং যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং যার কর্ম বিনষ্ট হয়েছে।’ (সুরা কাহাফ ২৮)
অহংকারী হৃদয় : যে হৃদয় অহংকারে পরিপূর্ণ। অহংকারের কারণে সে ভালো জিনিসের অনুসরণ করতে পারে না। এমনকি আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য তার জন্য অহংকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে প্রবল ক্ষমতাধর মনে করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এভাবেই আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তির হৃদয়ে মোহর মেরে দেন।’ (সুরা গাফির ৩৫)
কঠোর হৃদয় : যে হৃদয়ে কোনো ধরনের দয়ার লেশমাত্র নেই। কারো দুঃখে তার হৃদয় ব্যথিত হয় না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে যেত।’ (সুরা আলে-ইমরান ১৫৯)
মোহরকৃত হৃদয় : যে অন্তরে মোহর মেরে দেওয়া হয়েছে। এমন ব্যক্তি হেদায়াতের কথা শুনে না। আর শুনলেও তার জীবন পরিবর্তন হয় না। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ তাদের হৃদয়ে ও কানে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখসমূহে রয়েছে পর্দা। আর তাদের জন্য রয়েছে মহা আজাব।’ (সুরা বাকার ৭)
বাঁকা হৃদয় : যে হৃদয়ে কখনো ভালো জিনিস থাকে না বা ভালো পথ দেখে না। সত্যটা সামনে এলেও বাঁকা পথে চলতে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যাদের হৃদয়ে বক্রতা আছে তারা মুতাশাবিহ (ব্যাখ্যাসাপেক্ষ) আয়াতের পেছনে পড়ে থাকে।’ (সুরা আলে ইমরান ৭)
মহান আল্লাহ আমাদের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করার তওফিক দান করুন। যেন পরিশুদ্ধ হৃদয়ে তার ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ অর্জন করতে পারি। আমিন।
লেখক : মাদ্রাসাশিক্ষক ও প্রবন্ধকার
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.