ধর্ম ডেস্ক:
মানবজাতির সমগ্র জীবনব্যাপী অনন্য নির্দেশিকা ইসলাম। এর মূল দর্শনেই নিহিত শান্তি ও সহনশীলতা। কোরআন ও হাদিসে বারবার মানুষকে অহিংসার পথ বেছে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সহিংসতা, অবিচার ও অত্যাচার মানুষের নৈতিক ও সামাজিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই ইসলামে অহিংসাকে কেবল নৈতিক আদর্শ নয়, বরং একটি অনিবার্য ধর্মীয় শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা জমিনে সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কোনো মানুষের প্রাণ বাঁচাল, সে যেন পৃথিবীর সব মানুষকে বাঁচাল।’ (সুরা মায়িদা ৩২)
এই আয়াত আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয় যে, অন্যের জীবনকে বিনা অপরাধে শেষ করা কতটা গুরুতর পাপ। ইসলামে জীবনকে সবচেয়ে পবিত্র হিসেবে উল্লেখ হয়েছে এবং এটি রক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সহিংসতা কেবল শারীরিক ক্ষতি নয়, বরং আত্মিক ও সামাজিক ক্ষতিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানবিক ও সহনশীলতার প্রতীক। তিনি কখনো অন্যায়ের প্রতিশোধের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে বলেননি। যুদ্ধের সময়ও তিনি নিরীহ মানুষের ক্ষতি, নারী ও শিশুদের ওপর আক্রমণ, বৃক্ষ ও সম্পদ ধ্বংসকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে ইসলামে সহিংসতা কখনো অনুমোদিত নয়।
ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী অহিংসা কেবল বাহ্যিক আচরণে নয়, হৃদয়ের অবস্থাতেও প্রয়োগ করতে হয়। মানুষকে শত্রুর প্রতিও সহানুভূতিশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ধৈর্যধারণ করে এবং ক্ষমা করে, তা নিশ্চয় দৃঢ়সংকল্পেরই কাজ।’ (সুরা শুরা ৪৩) এটি নির্দেশ করে, অহিংসা শক্তির প্রতীক, সহিংসতা নয়।
ইসলাম বলে, অন্যায় বা জুলুমের জবাব শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে নয়, বরং ন্যায়, ধৈর্য ও সমঝোতার মাধ্যমেই হওয়া উত্তম। মহান আল্লাহ কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘আর ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত করো তা দ্বারা যা উৎকৃষ্টতর, ফলে তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে সে যেন হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা হামিম সাজদা ৩৪) এই আয়াত মানুষকে শেখায়, প্রতিশোধ নয় বরং উত্তম চরিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমেই প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন এ বিষয়ে সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। মক্কায় তিনি নানা ধরনের নির্যাতন ও অবমাননার শিকার হয়েছিলেন, কিন্তু কখনো প্রতিশোধ নেননি। বরং তিনি দোয়া করেছেন, ‘হে আল্লাহ, তারা বুঝে না, তাই ক্ষমা করে দিন।’ হাদিসে এসেছে, মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। (সহিহ বুখারি) এই শিক্ষা আসলে অহিংস জীবনের মূলনীতি।
আধুনিক সমাজে অহিংসার শিক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলেই আমরা হিংসা, সংঘাত আর রক্তপাতের খবর পাই। কখনো রাজনৈতিক বিরোধ, কখনো অর্থনৈতিক স্বার্থ, আবার কখনো ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত বিবাদের কারণে মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে। এতে মানুষ হারাচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাপন, সমাজ হারাচ্ছে শান্তির পরিবেশ। অথচ ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে অহিংসার পথে আহ্বান করে, বিশেষ করে ইসলামের শিক্ষা এখানে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও দিকনির্দেশনামূলক। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অহিংসার নীতি অনুসরণ করলে মানবিক সম্পর্ক দৃঢ় হয় এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে যদি মানুষ অহিংসার আদর্শ মেনে চলে তবে পরিবারে সম্পর্ক দৃঢ় হয়। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া কিংবা ভাই-বোনের বিবাদ সহজেই মিটে যায়। সামাজিক জীবনে অহিংসার চর্চা করলে প্রতিবেশীর সঙ্গে দৃঢ় বন্ধন গড়ে ওঠে, কলহ-কোন্দল দূর হয়। আর রাষ্ট্রীয় বা বৈশ্বিক পরিসরে অহিংসার নীতি অনুসরণ করলে যুদ্ধ, রক্তপাত ও ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানো যায়।
আজকের দুনিয়ায় যেখানে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই হিংসার প্রভাব দৃশ্যমান, সেখানে অহিংসার চর্চা খুবই জরুরি। ইসলাম আমাদের দেখিয়েছে, শক্তি দিয়ে নয়, ন্যায় ও শান্তিপূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমেই সমস্যার সঠিক সমাধান সম্ভব। তাই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যেককে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে অহিংস জীবনধারাকে অনুসরণ করতে হবে। এভাবেই গড়ে উঠতে পারে প্রকৃত মানবিক, নিরাপদ ও শান্তিময় সমাজ।
মানুষের প্রতি সদয় হওয়া, অপরের ক্ষতি থেকে বিরত থাকা, দমন-পীড়ন ও অন্যায় প্রতিরোধে শান্তিপূর্ণ পথ বেছে নেওয়া সব মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ জীবনে এটি বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি কখনো কারও ক্ষতি করেননি, বরং ক্ষমাশীলতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
সহিংসতা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, সামাজিক ও বিশ্বশান্তিকেও বিপর্যস্ত করে। ইসলামের শিক্ষায় শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত প্রতিরোধই মূল। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই নীতি প্রয়োগ করলে ব্যক্তি ও সমাজ দুটোই উন্নত হবে।
অহিংসা ইসলামের মূল শিক্ষা। এটি আমাদের আত্মা, মনন ও আচরণে শৃঙ্খলা এনে দেয়। কোরআন ও হাদিসের আলোকে বোঝা যায়, সত্যিকারের শক্তি সহিংসতার নয়, বরং ধৈর্য, ক্ষমা ও মানবিকতার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। মুসলিম সমাজে এই শিক্ষার বাস্তবায়ন শুধু নৈতিক উন্নতি নয়, বরং সামাজিক শান্তি ও সমৃদ্ধিরও পথপ্রদর্শক।
অহিংসা সুন্দর জীবনযাত্রার ভিত্তি। এটি ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টি থেকে শুরু করে সামাজিক সম্পর্ক পর্যন্ত প্রভাব ফেলে। মানুষের হৃদয় যদি অহিংসার নীতি অনুসরণ করে, তবে সমাজে সহমর্মিতা, ন্যায় ও শান্তি অটুট থাকে। এই শিক্ষাই আমাদের শেখায়, সহিংসতা চরম দুর্বলতার পরিচয়, আর শান্তি ও সহমর্মিতা হলো প্রকৃত শক্তি।
লেখক : মাদ্রাসা শিক্ষক ও ধর্মীয় নিবন্ধকার
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.