আইনাল হক:
মানুষ সামাজিক জীব। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, সম্মান ও সম্পদের সুরক্ষা নির্ভর করে ন্যায়ভিত্তিক ও অপরাধমুক্ত সমাজের ওপর। কিন্তু প্রতিটি যুগে কিছু মানুষ লোভ, হিংসা ও ক্ষমতার অপব্যবহারে অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করেছে। ফলে সমাজে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা, অন্যায় ও নৈরাজ্য। ইসলাম এই অশান্তি রোধে দিয়েছে পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা, যেখানে অপরাধ প্রতিরোধ ও দমন, দুটিকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনায় গড়ে উঠেছে এমন বিচারব্যবস্থা, যা একদিকে অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেয়, অন্যদিকে সমাজকে অপরাধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করে।
ইসলামি বিধান মতে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, যেসব কারণে অপরাধ সংঘটিত হয়, তা থেকে সমাজ ও দেশকে মুক্ত রাখা। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের ধারা অব্যাহত রাখা। মানুষের মানসিকতায় মহান আল্লাহর ভয়ভীতি জাগ্রত করা। জনগণের হৃদয়ের গহিনে এ কথা বসিয়ে দেওয়া যে, অপরাধ যত গোপনেই করা হোক, আল্লাহ তা দেখেন। পরকালে সবকিছুর জবাবদিহি করতে হবে। অপরাধ ও গুনাহের শাস্তি ভোগ করতে হবে। সেখানকার শাস্তি দুনিয়ার শাস্তির চেয়ে অনেক কঠিন। এরপরও কেউ অপরাধ করলে ইসলাম তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের নিয়ম রেখেছে।
ইসলামে শাস্তির বিধান তিন ধরনের। এক. কিছু শাস্তি আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তবে কার্যকর করার দায়িত্ব অপরাধীর নিজের ওপর ন্যস্ত করেছেন। যেমন বিভিন্ন ধরনের কাফফারা। দুই. যে শাস্তি কোরআন বা হাদিস দ্বারা নির্দিষ্ট। তা কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। এ ক্ষেত্রে বিচারক বা সরকারের নিজস্ব মতামতের কোনো সুযোগ নেই। যেমন হদ ও কেসাস। তিন. যেসব অপরাধের শাস্তির কোনো পরিমাণ নির্ধারিত হয়নি, বরং বিচারকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিচারক স্থান, কাল ও পরিবেশ বিবেচনা করে অপরাধ দমনের জন্য যেমন ও যতটুকু শাস্তির প্রয়োজন মনে করেন, ততটুকুই দেবেন। শরিয়তের পরিভাষায় তাকে ‘তাজির’ বলা হয়। অপরাধ দমনে ইসলামি বিধানের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ।
প্রতিরোধমূলক : ইসলাম অপরাধের পথ খোলা রেখে অপরাধ করার সুযোগ দেয় না, বরং অপরাধের কারণ যাতে সংঘটিত না হয় তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যেমন খুনখারাবি রোধে সামাজিক দ্বন্দ্ব-কলহের অবসান ঘটায়। চুরি-ডাকাতি রোধে সম্পদের সুষম বণ্টনের নির্দেশ দেয়। ব্যভিচার রোধে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও যৌন প্রবৃত্তি উদ্দীপক সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ইনসাফ : ইসলাম বিচারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে। অপরাধী ও যাদের বিরুদ্ধে সে অপরাধ করেছে, উভয়ের অবস্থা বিবেচনা করে। ইসলাম চোরের হাত কেটে দিতে বলে। কিন্তু যেখানে সামান্যতম সন্দেহ থাকে যে চোর ক্ষুধার তাড়নায় চুরি করেছিল, সেখানে কিছুতেই এ শাস্তি দেওয়া হয় না। সামান্য জিনিস চুরির জন্য হাত কাটার নির্দেশ দেয় না। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে, ১০ দিরহামের (প্রায় তিন হাজার টাকা) কম পরিমাণ চুরির ক্ষেত্রে হাত কাটা যাবে না।
ছোট-বড়, ধনী-গরিব, সাদা-কালো সবার জন্য ইসলাম একই শাস্তির বিধান দেয়। দেশের কোনো ব্যক্তিই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, বনু মাখজুম গোত্রের এক নারী চুরি করেছিল। এতে কুরাইশরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা বলাবলি করে, শাস্তি মাফ করানোর জন্য কে নবীজি (সা.)-এর কাছে এ ব্যাপারটি উত্থাপন করবে? তার প্রিয় পাত্র ওসামা ইবনে জায়েদ (রা.) ব্যতীত আর কে এ সাহস করবে? এরপর ওসামা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এ ব্যাপারে আলোচনা করেন। তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি কি আল্লাহর দণ্ডবিধিসমূহ থেকে এক দণ্ডের ব্যাপারে সুপারিশ করছ?’ তারপর তিনি দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের আগেকার লোকদের নীতিও ছিল এ রকম, যখন কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি চুরি করত, তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন তাদের মধ্যে কোনো দুর্বল ব্যক্তি চুরি করত, তখন তার ওপর দণ্ড প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মদ (সা.)-এর মেয়ে ফাতিমাও চুরি করে, তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দেব।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ ৩১৩)
সংশোধনমূলক : আল্লাহর হক সম্পর্কিত অপরাধের জন্য ইসলাম অপরাধীকে তওবা করার সুযোগ দেয়। একনিষ্ঠ নিয়তে তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। ফলে সে নিজে সংশোধিত হওয়ার সুযোগ পায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, আন্তরিক তওবা। তাহলে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কর্মগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (সুরা তাহরিম ৮)
দৃষ্টান্তমূলক : ইসলাম কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে কঠিন শাস্তির বিধান রেখেছে। তা জনসমক্ষে দিতে হয়। যাতে সবাই শাস্তির কঠোরতা দেখে অপরাধ থেকে বিরত থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বুদ্ধিমানরা! কেসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার।’ (সুরা বাকারা ১৭৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ ছিল শান্তি, ন্যায়বিচার ও সামাজিক নিরাপত্তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার নেতৃত্বে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় অপরাধ প্রতিরোধ ও ন্যায়বিচারের স্বচ্ছতা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা হলো, অপরাধ প্রতিরোধ করা এবং অপরাধীদের ন্যায়বিচারের আওতায় আনা। রাসুল (সা.)-এর শাসনামলে অপরাধ প্রতিরোধে বেশ কিছু মূলনীতি অনুসরণ করা হতো।
মুসলিম সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি অপরাধ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করত। কারও আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে জানানো হতো। কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে শক্তিশালী প্রমাণ ও নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যের প্রয়োজন হতো। বিচারের সময় পক্ষপাতহীনতা নিশ্চিত করা হতো এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণিত হলে যথাযথ শাস্তি প্রদান করা হতো।
কেউ অপরাধ করলে প্রথমে অভিযোগ দায়ের করা হতো। অভিযোগ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করা হতো। প্রাথমিক তদন্তে অপরাধের সত্যতা নিশ্চিত হলে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হতো। অপরাধীকে গ্রেপ্তারের সময় যথাসম্ভব অহিংস পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। অপরাধ প্রমাণিত হলে কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করা হতো।
একদা গণিমতের সম্পদ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে, যেখানে যুদ্ধের মালের বিষয়ে অসতর্কতা দেখা দেয় এবং তা ধরা পড়ে। রাসুল (সা.) কঠোরভাবে এর নিন্দা করেন এবং বলেন, ‘যে কেউ গণিমতের সম্পদ আত্মসাৎ করে, সে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে। এরপর তাকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হয়।’
রাসুল (সা.)-এর শাসনামলে অপরাধীদের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত সুবিন্যস্ত, ন্যায়নিষ্ঠ এবং মানবিকতাপূর্ণ। বর্তমান যুগেও এই নীতিমালা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, যা একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক হতে পারে।
ইসলামের কঠোর শাস্তি ব্যবস্থার মধ্যেও রয়েছে মানবিকতার পরিপূর্ণ ভারসাম্য। এর লক্ষ্য অপরাধীকে ধ্বংস করা নয়, বরং তাকে সংশোধনের পথে ফিরিয়ে আনা এবং সমাজে অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা। তাই ইসলামে অপরাধ প্রতিরোধের মূলভিত্তি হলো ইমান, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের বিকাশ। যখন মানুষের মনে আল্লাহভীতি জাগ্রত হয়, তখন সে নিজের বিবেকের আদালতেই নিজেকে জবাবদিহির মুখোমুখি দেখে। এই আত্মনিয়ন্ত্রণই সমাজে স্থায়ী শান্তির ভিত্তি গড়ে তোলে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগের ন্যায় যদি সমাজে ন্যায়ের স্বচ্ছতা, আইনের সমতা ও অপরাধবিরোধী চেতনা প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবে আজও পৃথিবী শান্তি ও নিরাপত্তার আবাসস্থল হয়ে উঠতে পারে।
লেখক : মাদ্রাসাশিক্ষক ও প্রবন্ধকার
ভয়েস/আআ/সূত্র:দেশরূপান্তর
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.