মুফতি মাহবুব হাসান:
আমরা বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে বসবাস করছি। এ যুগেও মানুষ ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস পাওয়ার প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারেনি। কোরআন ও হাদিস ভূমিকম্পকে শুধু ভূতাত্ত্বিক ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেনি। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি মানুষের জন্য সতর্কতা, আত্মসমালোচনার আহ্বান এবং আল্লাহর অপরিসীম ক্ষমতার স্মরণ। মানুষ যখন অন্যায় ও উদাসীনতায় ডুবে যায়, যখন পাপাচার প্রবল হয়, তখন জমিনের কাঁপন মানবজীবনে সতর্ক ধ্বনি তোলে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে রাজধানীর জনজীবন যে অস্থিরতায় নিমজ্জিত হয়েছে, তা শুধু বিপদের অনুভূতি নয়, বরং কোরআনে বর্ণিত সেই ভয়াবহ দিনের ইঙ্গিতও স্মরণ করিয়ে দেয়, যেদিন জমিনের থরথর কাঁপন মানুষের সব অহংকার গুঁড়িয় দেবে। এই বাস্তবতায় প্রয়োজন কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে ভূমিকম্পের প্রকৃত তাৎপর্য নতুনভাবে উপলব্ধি করা।
ভূমিকম্প সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘এ উম্মত ভূমিকম্প, বিকৃতি এবং পাথর বর্ষণের মুখোমুখি হবে। একজন সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, কখন সেটা হবে হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বলেন, যখন গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রকাশ ঘটবে এবং মদপানের সয়লাব হবে।’ (তিরমিজি)
নবীজি (সা.) আরও বলেছেন, ‘যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে, কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখলে তা আত্মসাৎ করা হবে, জাকাতকে মনে করা হবে জরিমানা, ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে, পুরুষ তার স্ত্রীর বাধ্যগত হয়ে মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে নিয়ে বাবাকে দূরে সরিয়ে দেবে, মসজিদে শোরগোল (কথাবার্তা) হবে এবং সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তি সমাজের শাসক হবে। সেই সময় তোমরা অপেক্ষা করো রক্তিম বর্ণের ঝড়ের, ভূকম্পনের, ভূমিধসের, লিঙ্গ পরিবর্তন, পাথর বৃষ্টির এবং সুতো ছেঁড়া (তাসবিহ) দানার ন্যায় একটির পর একটি নিদর্শনের জন্য।’ (তিরমিজি)
অন্যত্র বলা হয়েছে, ভূমিকম্প হচ্ছে কেয়ামতের একটি অন্যতম আলামত। কেয়ামত যতই নিকটবর্তী হবে, ভূমিকম্পের পরিমাণ ততই বাড়তে থাকবে। ভূমিকম্পের বিভীষিকা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মানব জাতি, তোমরা ভয় করো তোমাদের রবকে। নিশ্চয়ই কেয়ামত দিবসের ভূকম্পন হবে মারাত্মক ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, স্তন্যপায়ী মা তার দুগ্ধপোষ্য সন্তানের কথা ভুলে যাবে, সব গর্ভবতীর গর্ভপাত হয়ে যাবে। মানুষকে মাতালের মতো দেখাবে, আসলে তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।’ (সুরা হজ ১-২)
রাজধানী ঢাকায় ভয়ংকর ভূমিকম্প হয়েছে। ইতিপূর্বে এমন ভয়ংকর পর্যায়ের হয়নি। সব মানুষ রাস্তায় বের হয়ে এসেছে। সবার চোখে মুখে অস্থিরতা। কোরআনের এই বর্ণনা অনুযায়ী, কেয়ামতের সময়ের ভূমিকম্প কতটা ভয়ংকর পর্যায়ের হবে, তা কি আজকের ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়?
মানুষের অকৃতজ্ঞতা, উদাসীনতা ও অন্যায় যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন আল্লাহতায়ালা সতর্ক করে দেন, এই পৃথিবী ও তার স্থায়িত্ব কেবল তারই ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। পবিত্র কোরআনের সুরা মুলকের ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষের মিথ্যা নিরাপত্তা বোধ নিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা কি নিজেদের নিরাপদ মনে করে নিয়েছ যে, যিনি আকাশে আছেন তিনি তোমাদের জমিনে বিধ্বস্ত করে দেবেন না, যখন তা হঠাৎ থর থর করে কাঁপতে থাকবে?’
এই আয়াতের মর্মার্থ অত্যন্ত গভীর। মানুষ মাটির ওপর শক্ত ইমারত গড়ে নিজেকে সুরক্ষিতভাবে। অথচ আল্লাহ চাইলে সেই স্থির জমিনকেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত করতে পারেন। যখন জমিন কাঁপতে শুরু করে তখন মানুষের পালানোর কোনো জায়গা থাকে না। এটি আল্লাহর অসীম ক্ষমতার এক সামান্য নিদর্শন মাত্র, যা তিনি বান্দাদের সতর্ক করার জন্য প্রদর্শন করেন।
মানুষ অনেক সময় মনে করে, বিপদ হয়তো শুধু রাতের আঁধারে আসে অথবা যখন তারা ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহর আজাব আসার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয় না। মানুষ যখন দিনের আলোয় খেলাধুলা বা পার্থিব আমোদ প্রমোদে মগ্ন থাকে ঠিক তখনই নেমে আসতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। সুরা আরাফের ৯৮ ও ৯৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘জনপদের অধিবাসীরা কি নিরাপদ হয়ে গেছে যে, আমার শাস্তি তাদের ওপর দিনের বেলায় আসবে না? যখন তারা খেলাধুলায় মেতে থাকবে। তারা কি আল্লাহর কৌশল থেকেও নিরাপদ হয়ে গেছে? বস্তুত ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া কেউই আল্লাহর কৌশলকে নিরাপদ মনে করে না।’
এখানে আল্লাহর কৌশল বলতে তার গোপন পরিকল্পনা বা শাস্তির বিধানকে বোঝানো হয়েছে, যা লোকচক্ষুর অন্তরালে সক্রিয় থাকে। যারা বুদ্ধিমান তারা কখনোই আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেদের নিরাপদ মনে করে না, বরং সর্বদা ভীত ও সতর্ক থাকে।
শাস্তি শুধু আসমান থেকে নয়, বরং পায়ের নিচ থেকেও আসতে পারে। সুরা আনআমের ৬৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো, আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম।’
এই আয়াতটি যখন নাজিল হয় তখন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ হাদিসটি সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, যা বিষয়টির গুরুত্ব ও ভয়াবহতা প্রমাণ করে। প্রখ্যাত মুফাসসির শায়েখ ইস্পাহানি রহমতুল্লাহি আলাইহি এই আয়াতের তাফসিরে উল্লেখ করেছেন, এখানে পায়ের নিচ থেকে আজাব আসার অর্থ হলো ভূমিকম্প ও ভূমিধস। অর্থাৎ যে মাটি আমাদের ভার বহন করে, তা যেকোনো মুহূর্তে আমাদের গ্রাস করে নিতে পারে।
আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে মানুষ ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়াকে দায়ী করে থাকে। কিন্তু একজন মুমিনের দৃষ্টিতে এর কার্যকারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুমিন বিশ্বাস করে, এই প্রাকৃতিক নিয়মগুলো মহান আল্লাহর নির্দেশেরই অধীন। যখন পৃথিবীতে পাপাচার, অনাচার এবং আল্লাহর নাফরমানি বেড়ে যায়, তখন আল্লাহতায়ালা জমিনকে প্রকম্পিত করে মানুষকে সতর্ক করেন। এটি কোনো সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং এটি আল্লাহর দিকে ফিরে আসার ডাক।
সুতরাং বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে, তা মহান আল্লাহর পাঠানো সতর্কবার্তার নিদর্শনগুলোর একটি। এগুলো দিয়ে তিনি বান্দাদের সাবধান করেন। মূলত এগুলো মানুষের পাপ ও অপরাধের ফল।
ভূমিকম্প এমনই এক দুর্যোগ, যা নিবারণ, প্রতিকার বা প্রতিরোধ করা বা পূর্বাভাস পাওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি মানুষ এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। সুতরাং ভূমিকম্পের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও আশ্রয় প্রার্থনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
বান্দার অপরাধ ক্ষমা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যে বিপদ-আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই। আর আল্লাহ তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা শুরা ৩০)
আমাদের উচিত আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা। নিজেদের গুনাহের জন্য লজ্জিত হয়ে তওবা করা এবং ভবিষ্যতে আল্লাহ ও তার রাসুলের দেখানো পথে চলার দৃঢ় সংকল্প করা। কারণ একমাত্র আল্লাহই পারেন আমাদের এই ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা করতে।
শেষ পর্যন্ত একটি সত্যই স্পষ্ট হয়ে উঠে প্রযুক্তি, জ্ঞান, প্রস্তুতিসহ কোনো কিছুই এক মুহূর্তের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। তবে আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে আগেই সতর্ক করে দেন, পাপাচার যখন বাড়তে থাকে, নাফরমানিতে মানুষ ডুবে যায়, তখন প্রকৃতির মাধ্যমে তিনি বান্দাদের চোখ খুলে দেন। ভূমিকম্প সেই সতর্কতা। এটি মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবী কারও স্থায়ী আবাস নয়।
এসব কিছু আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায়, আমরা কি সত্যিই আল্লাহর নির্দেশ মানছি? আমাদের জীবন কি তার সন্তুষ্টির পথে চলছে? বিপর্যয় মানুষের জন্য শাস্তি হওয়ার পাশাপাশি রহমতও, যদি তা মানুষের হৃদয়ে জাগরণ ঘটায়। আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকার পথ হলো তওবা, অনুতাপ এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসা।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.