তুষার আবদুল্লাহ:
আমার গলির দৈর্ঘ্য ছোট। দশ, বারো বাড়িতেই গলির দিগন্ত শেষ। এই ছোট পরিসরের গলিতেও তিনটা চায়ের দোকান খুলেছে। সকাল, বিকাল, রাতে এই তিন দোকান ঘিরে কিশোর তরুণদের আড্ডা দেখি। এদের বেশিরভাগকেই আমি চিনি না। একটা সময় ছিল মহল্লায় নতুন কোনও মুখ দেখলেই বুঝতে পারতাম। এখন বুঝি না। বড় বড় দালান হয়েছে। পরিবার ছাড়াও অনেক তরুণ তরুণী মেস করে থাকে এসব দালানে। মহল্লায় ঘনিষ্ঠ অভিজাত এলাকার বিভিন্ন অফিস, দোকানে কাজ করেন তারা। অনেকের চোখেই চোখ পড়ে, কথা হয় না। তরুণদের অনেকে পথ রোধ করে ধূমপান করে। পথ ছেড়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করে না। নিজেই নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে মাথা নুইয়ে পথ বের করে চলে যাই। শুক্রবার ছুটির দিনে মধ্যাহ্নভোজের পরপর বেরিয়ে গলির মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। একটা চায়ের দোকান ছাড়া সব দোকান বন্ধ। তিন তরুণ আড্ডা দিচ্ছে। দুইজন একটি কোমল পানীয়ের বোতল সহভাগ করে খাচ্ছিল। আরেকজনের হাতে চায়ের কাপ। তিনজনই চিন্তিত তাদের কাজ নিয়ে। করোনার মন্দাকালে এখনও তিনজনের কেউ কাজ হারাননি। তবে খুব বেশি দিন কাজটা থাকবে বলে নিজেরাই বিশ্বাস করতে পারছে না। তিনজন পৃথক তিনটি অভিজাত শোরুম, সুপারশপে কাজ করেন। তাদের হিসাবমতো দৈনিক বিক্রির পরিমাণ অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। সুপারশপে ক্রেতা ঢুকলেও, অভিজাত শোরুমে ক্রেতা ঢুকছেন না বলেই চলে। ফলে মাসিক আয় নেমে এসেছে তিন দোকানেরই এক তৃতীয়াংশে। এরই মধ্যে দোকানের কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। বড় অঙ্কের ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মিটিয়ে দোকান চালু রাখা প্রায় অসম্ভব। মালিকরা অন্যান্য উৎস থেকে টাকা এনে ব্যবসা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এভাবে মাস ছয় চললে আর দোকান খোলা রাখা সম্ভব হবে না। ওই তরুণদেরই একজন বললেন, তিনি ও তার বন্ধুরা অনলাইনে পণ্য বিক্রির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেখানেও কোনও ভরসার খবর নেই। দোকান, অনলাইন কোথাও ক্রেতার ভিড় নেই।
আজ যখন লেখাটি লিখছি তখন দেশসেরা বড় একটি শিল্প গ্রুপের দু’জন কর্তা এসেছিলেন। তাদের শিল্প গ্রুপের হাজারও পণ্য। দেশের নানা প্রান্তে তাদের শিল্প এলাকা। জানালেন—অর্থনীতি এমন স্থবির থাকলে, কোনও কোনও প্ল্যান্ট তাদের বন্ধ করে দিতে হবে বা সীমিত করে আনতে হবে। অর্থাৎ তখন লোক ছাঁটাই অনিবার্য। নীরবে লোক ছাঁটাই কিন্তু প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেই চলছে। দোকান থেকে শীর্ষ শিল্প গ্রুপ সর্বত্র কাজ হারানোর আতঙ্ক। কোথাও কোথাও বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরে বসে অফিস করাকে উৎসাহিত করে কমানো হচ্ছে বেতনভাতা। প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ব্যয়ও কমিয়ে আনা হয়েছে। দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান হয়তো প্রকাশ্যে এনেছে তাদের ব্যয় সংকোচন নীতি। কোভিড-১৯ বিদায় নেয়নি। আরও দীর্ঘ অজানা সময় পর্যন্ত এর প্রভাব থাকবে। এখন আমরা প্রকাশ্যে রাজধানীসহ সারাদেশের যে চিত্রটি দেখছি, সেটি স্বাভাবিক চিত্র নয়। আমাদের সমাজবিদ ও অর্থনীতিবিদদের সকলে যে সত্য কথা বলছেন তাও নয়। বরং কেউ কেউ বলছেন বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। করোনাকে পরাজিত করেছে। এসবই লোক ভুলানো কথা। প্রায় অর্ধ কোটি মোবাইলের গ্রাহক কমে যাওয়াকেও অর্থনীতির মন্দার গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে গণ্য করতেই হবে। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেও মোবাইল ব্যবহার কমেছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবেশের হার বেড়েছে বলে অতি উল্লসিত হওয়ার সুযোগে নেই। কারণ মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা কাজ হারিয়ে বা কাজ হারানোর আশঙ্কায় তাদের জমানো টাকা পাঠাতে শুরু করেছে, দেশে বিকল্প কিছু একটা করার জন্য। ইউরোপ আমেরিকায় প্রবাসী অনেকেই দেশে আর্থিক অসহায় অবস্থায় পড়া স্বজনদের জন্য টাকা পাঠানোর পরিমাণ বাড়িয়েছে। এই প্রবাহ খুব বেশিদিন টেকসই হবে না।
রাজধানী বা বড় শহরে কাজ হারিয়ে যারা গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকে সেখানে এখনও কাজ জোগাড় করতে পারেননি। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও করোনার কারণে গ্রামেও কাজের সুযোগ কমে গেছে। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় কৃষিজ ও কুটির শিল্পের ক্রেতা কমেছে। দামি সবজির চাহিদা কম। কমেছে দুধ ও গোস্ত, মাছের চাহিদা। ফলে তৃণমূলের অর্থনীতিও এখনও ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সকল পর্যায় থেকে অর্থনীতির সত্য চিত্র তুলে ধরতে হবে। করোনা মহামারিতেও দুর্নীতি ও অনিয়মমুক্ত হয়নি সমাজ, রাষ্ট্র। সুতরাং এই দুই রোগ সঙ্গে নিয়ে নতুন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাও সম্ভব নয়। তাই সবার আগে সংকট না লুকিয়ে সত্য চিত্র তুলে ধরা প্রয়োজন। এই সংকট মোকাবিলায় সকলের শপথ নিতে হবে—যা বলিবো সত্য বলিবো। মিথ্যা বলিবো না।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.