বুধবার, ০৯ Jul ২০২৫, ০৪:৫৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।
শিরোনাম :
হিমছড়ি সৈকতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ দুই শিক্ষার্থীর একজনের মরদেহ উদ্ধার শহর গ্রামে বেড়েছে চোরের উপদ্রব মহেশখালীর সব্বির আহমেদ, আব্দুল জলিল ও মৌলানা ইলিয়াসের মৃত্যুতে ডক্টর হামিদুর রহমান আযাদের শোক হোয়াইট হাউসের ধন্যবাদ পেল পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ‘ভালো’ বলা পর্যবেক্ষকদের আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষণে না নেয়ার ইঙ্গিত সিইসির এসএসসির ফল প্রকাশ ১০ জুলাই দুপুর ২টায় প্রধান উপদেষ্টা ও তাসনিম জারাকে নিয়ে কটুক্তিকারী মেকানিক রেজাউল বরখাস্ত হিমছড়ি সৈকতে গোসল করতে নেমে শিক্ষার্থীর মৃত্যু কক্সবাজারে স্বাস্থ্য সহকারীদের অবস্থান কর্মসূচি পালিত টানা বৃষ্টিতে কক্সবাজারে অর্ধশতাধিক গ্রামে জলাবদ্ধতা: দুর্ভোগে লক্ষাধিক মানুষ

রোহিঙ্গা সংকট : ক্ষতের গভীরতা কতটা মাপতে পারছি?

মোহসীন-উল হাকিম:

২০১৭ সালের অনুপ্রবেশের সময় থেকে রোহিঙ্গাদের এদেশে উপস্থিতিকে আমরা বড় সংকট বলছি। অথচ চার দশক আগে থেকেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অস্থিরতা চলছে। প্রতিবেশী দেশটির রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করাকে কেন্দ্র করেই সংকট ঘনীভূত হয়েছে।

১৯৭২-১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে কয়েক দফার সংঘর্ষ-সংঘাতে দেশ ছাড়া হয়েছে মিয়ানমারের এই জনগোষ্ঠী। কখনো ধর্ম আবার কখনো নাগরিকত্ব নিয়ে বিরোধে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত নাগরিকেরা।

নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা ছাড়াও প্রতিনিয়ত সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এভাবেই বাংলাদেশের মাটিতে এখন বসবাস করছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১২/১৩ লাখ মিয়ানমারের নাগরিক।

টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং। ১৯৯১-১৯৯২ সালের অনুপ্রবেশের পর এই দুইটি জায়গায় দুটি নিবন্ধিত ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় শরণার্থীরা। আর এর পাশেই গড়ে উঠেছিল অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প (স্থানীয় ভাবে যাকে টাল বলা হয়)। সেই টালগুলোতে বাড়তে থাকে রোহিঙ্গা বসতি। সেখান থেকে আশপাশের গ্রাম, শহর হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে অনেকে।

২০১২ সালের ইনফ্লাক্স (একসঙ্গে অনেক মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া) এর পর অবশ্য পালিয়ে আসা মিয়ানমারের এই নাগরিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারকদের পক্ষ থেকে নেওয়া সেই সিদ্ধান্তের পর থেকে মাঠ পর্যায়ে এ নিয়ে নড়াচড়া শুরু হয়। সেই দফায় অনুপ্রবেশ করতে না দেওয়ার সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকেই মনক্ষুণ্ন ছিলেন। মানবিক দিক বিবেচনায় সেই সিদ্ধান্তকে কেউ কেউ মেনে নিতে পারেননি।

২০১৭ সালের ইনফ্লাক্স বা অনুপ্রবেশের কারণে যখন বাংলাদেশ সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় তখন প্রায় সকলেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। স্থানীয়দের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখা যায়। আবার আরেকটি পক্ষ প্রতিবাদ করে, সীমান্ত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে হঠকারী হিসেবে উল্লেখ করেন তারা।

কৌশলগত কারণে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের কারণে যা হয়েছে তা হলো, শুরুতেই বাংলাদেশে অবস্থানরত নতুন-পুরাতন রোহিঙ্গাদের একটি তালিকা হয়েছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে করা সেই তালিকাই আপাতত মিয়ানমার থেকে আসা মানুষদের প্রধান তথ্য, প্রমাণও বলা যায়।

বিশাল এই শরণার্থী জনগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করছে বাংলাদেশ। ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে ১২ লাখ মানুষের ব্যবস্থাপনার মহাযজ্ঞটি চলছে জোরেশোরে। কক্সবাজারে অস্থায়ী ও স্থায়ী কার্যালয় গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় এনজিওগুলো। সবশেষ ইনফ্লাক্স ঘটে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে।

চতুর্থ বছরে আমরা। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে ফিরে না যাওয়া নিয়ে সংকট ঘনীভূত হয়েছে। সাময়িক আশ্রয়ের বিষয় হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত। বাংলাদেশের আবেগপ্রবণ মানুষদের আবেগ কেটে গেছে। গলার কাঁটার মতো বিধে যাওয়া মানুষগুলোর প্রতি সমবেদনাও উবে যাওয়ার পথে। বিশেষ করে প্রত্যাবাসনের বিষয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় সেই দোষ কার ঘাড়ে চাপানো যায় সেই সুযোগ খুঁজছি আমরা অনেকে।

অন্যদিকে কক্সবাজারের উখিয়া আর টেকনাফের মানুষদের দমবন্ধ অবস্থা। পাশের উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়িতেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এক সময়ের সহমর্মী বাংলাদেশের বাসিন্দাদের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কিন্তু তাদের সেই চিৎকার এখন আর আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। কারণ রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, স্থানান্তরসহ নানা ইস্যুতে সবকিছুই চাপা পড়ে গেছে। বিস্তীর্ণ সেই অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস, বনাঞ্চল উজারের বিষয় নিয়ে কথা বললেও তা গুরুত্ব পায় না। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম নষ্ট হওয়াসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে কথাবার্তা হলেও তা চাপা পড়ে যায় বড় বড় ইস্যুর ভিড়ে। এদিকে দিন দিন স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বাড়ছে।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা বসতিগুলোকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর অপরাধ বিশাল আকার ধারণ করল কী? যদি তাই হয় তবে এতদিন ধরে আমরা কী করলাম? বিপদ এখানেই শেষ হতে পারত। আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে কিংবা হচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য কতটুকু আছে?
কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে, কমছে কৃষি জমি। দ্রব্যমূল্যে বিশাল প্রভাব পড়েছে। অর্থনৈতিক নানা সংকটে পর্যুদস্ত স্থানীয়রা। ক্যাম্পগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অপরাধী চক্রের সঙ্গে মিশে অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ইয়াবার পুরনো কারবারের সঙ্গে নতুন করে মিশে যাচ্ছে স্থানীয়রা। সব মিলিয়ে চরম জটিল আকার ধারণ করেছে।

এদিকে মিয়ানমারের এই নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও চাপা পড়ে যায় একই কারণে। স্থানীয় সংকটগুলো উঠে আসে সামনে। বিশেষ করে, আইনশৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে অনেক বেশি চাপ নিতে হয় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী সংস্থাগুলোকে।

২০১৭ সালের অনুপ্রবেশের পর টেকনাফের আনসার ক্যাম্পে হামলা, হত্যা আর অস্ত্র লুটের ঘটনা দিয়ে শুরু হয়। তারপর গহীন বনে ডাকাত চক্রের উত্থান, খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ছিনতাইসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ততা বাড়ে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার।

অন্যদিকে মানব পাচার, অবৈধ অস্ত্রের কারবার, ইয়াবা পাচার আর স্বর্ণ চোরাচালানের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের চক্র ডালপালা মেলতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা বসতিগুলোকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর অপরাধ বিশাল আকার ধারণ করল কী? যদি তাই হয় তবে এতদিন ধরে আমরা কী করলাম? বিপদ এখানেই শেষ হতে পারত। আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে কিংবা হচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য কতটুকু আছে? প্রস্তুতিই বা আছে কতটুকু?

দেশের দক্ষিণ-পূর্বের এই সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। অরক্ষিত সীমান্তে এখন সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর অবস্থা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হলে তা আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। কিন্তু বিজিবির কাউন্টারপার্টের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)’র সমন্বিত কোনো সীমান্ত ব্যবস্থাপনা কি গড়ে উঠেছে? মাঠ পর্যায়ের বিষয়গুলো নিয়ে তথ্য আদানপ্রদান, সরকার টু সরকার আলোচনা কি চলছে নিয়মমতো?

মিয়ানমার থেকে আসা নাগরিকদের যে তালিকা তৈরি করেছে বাংলাদেশ, সেই তালিকা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হছে কি? মানুষগুলো যে মিয়ানমার থেকে এসেছে সেই প্রমাণ তো চাইবে দেশটি। আর তা বাংলাদেশকেই প্রমাণ করতে হবে শেষ পর্যন্ত। সেই প্রস্তুতি আমাদের নেওয়া হয়েছে কি?
আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে যে, দ্বিপাক্ষিক কুটনৈতিক সম্পর্কে উষ্ণতা নেই। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারলে প্রত্যাবাসন কি শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে?

মোহসীন-উল হাকিম ।। বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION